দোকান থেকে সময় মতো ওষুধ এনে দেবে কে! শেষ বয়সে এটাই সব থেকে বড় সমস্যা ছিল প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সময় মতো একে-তাঁকে ধরে ওষুধ কিনতে হত সত্তর ছুঁইঁছুঁই ওই বৃদ্ধাকে।
প্রতিমাদেবীর মতো অবস্থা শহরের আরও অনেক প্রবীণেরই। যৌথ পরিবার ক্রমাগত ভাঙছে। অণু পরিবারে সন্তান পড়তে বা চাকরি করতে চলে যাচ্ছে ভিন্ শহরে। তার উপরে প্রতি ঘরেই বয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিসের মতো অসুখ রয়েছে। এই ধরনের অসুখে নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়। কিন্তু শহরে ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া প্রবীণদের পক্ষে সব সময়ে ওষুধের দোকানে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। নির্ভর করতে হয় পরিচারক কিংবা পরিচিত-আত্মীয়দের উপরেই। ফলে অনেক সময়ই সমস্যায় পড়েন ওই প্রবীণেরা।
সম্প্রতি প্রবীণদের এই সমস্যা থেকে রেহাই দেওয়ার পন্থা বার করেছে কয়েকটি সংস্থা। ফোনে বা ইন্টারনেট মারফত ওষুধের অর্ডার দিলে ঘরে বসেই তা মিলবে। তবে এ ক্ষেত্রে কোনও জরুরি ওষুধ পাওয়া যাবে না বলেই সংস্থাগুলির কর্তারা জানিয়েছেন। “ওষুধ বাড়ি পৌঁছতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। তাই জরুরি ওষুধের বরাত নেওয়া হয় না।”— মন্তব্য একটি সংস্থার শীর্ষ কর্তার। বস্তুত, কলকাতা পুলিশের এলাকায় ‘প্রণাম’ (লালবাজারের প্রবীণ সহায়তা প্রকল্প) কর্মসূচিতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বাড়িতে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া বা চিকিৎসক নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিটি থানায় প্রণাম প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা কর্মীরাই এই কাজ করেন। “কখনও কখনও গ্যাস বুকিংও করে দিতে হয়।”— মন্তব্য প্রণামের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ অফিসারের। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এমন সহায়তা দিতে আগে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও কাজ শুরু করেছিল।
ওষুধ সরবরাহের এই ই-পরিষেবা শুধু কলকাতা পুলিশ এলাকায় আটকে নেই। কলকাতা লাগোয়া শহরতলি বা বৃহত্তর কলকাতাতেও এই পরিষেবা মিলছে। একটি ওষুধ বিক্রি সংস্থার কর্তা বলছেন, “শুধু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নয়, নতুন প্রজন্মের ব্যস্ত পেশাদারেরাও এই সুবিধা পাবেন।”
কী ভাবে অর্ডার দেওয়া যাবে?
এই পরিষেবা প্রদানকারী একটি সংস্থার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ওষুধের বরাত দিতে গেলে অনলাইনে একটি ফর্ম পূরণ করতে হবে। তাতে গ্রাহকের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর দিতে হবে। লিখতে হবে কী কী ওষুধ প্রয়োজন, তার নাম, সংস্থার নাম, পরিমাণ ও মাত্রা। পাঠাতে হবে প্রেসক্রিপশনের একটি ছবিও। এ ভাবে অর্ডার দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রাহকের বাড়িতে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া হয় বলে সংস্থার কর্তাদের দাবি।
শহরের আর এক ওষুধ বিক্রয়কারী সংস্থা অবশ্য আরও এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের সুবিধার্থে একটি ফোন অ্যাপস বাজারে ছেড়েছেন তাঁরা। গুগ্ল কিংবা সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে সেই অ্যাপ ডাউনলোড করার পর সহজেই ওষুধের অর্ডার দেওয়া যাবে। তবে গ্রাহকদের অনেকেই প্রবীণ প্রজন্মের হওয়ায় টোল-ফ্রি নম্বরও রয়েছে। সংস্থার কর্তা জগন্নাথ নস্কর বলেন, “ওই নম্বরে ফোন করে অর্ডার দিলেও ওষুধ বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়।”
সংস্থার এক কর্তার দাবি, সাধারণত ফোনে কিংবা অ্যাপসে অর্ডার দেওয়া ওষুধ তাঁদের কুষ্টিয়া রোডের একটি দোকান থেকে পাঠানো হয়। তবে অনেক সময়ে গ্রাহকের নিকটবর্তী সংস্থার শাখা থেকেও ওষুধ পাঠানো হয়। কসবার এক প্রৌঢ় বাসিন্দা জানান, একটি বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদে চাকরি করেন তিনি। ব্যস্ততার জন্য সব সময় ওষুধের দোকানে যেতে পারেন না। “সকালে অর্ডার দিয়ে অফিস চলে যাই। রাতের মধ্যে ওষুধ বাড়ি পৌঁছে যায়।”—বললেন ওই প্রৌঢ়।
শহরের বিভিন্ন এলাকায় মুদি বা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের হোম ডেলিভারি ইতিমধ্যেই চালু হয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় হোম ডেলিভারির ক্ষেত্রে কর্মীরা ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড সোয়াইপ যন্ত্র নিয়ে যান। কিন্তু ওষুধ কেনার ক্ষেত্রে অনলাইন কিংবা হোম ডেলিভারির সময়ে কার্ড ব্যবহার এখনও শুরু হয়নি। বরং ওষুধ দিয়ে আসার সময়ে নগদ টাকাতেই দাম দিতে হয় গ্রাহকদের।
অনেকেই বলছেন, বাড়িতে সব সময়ে নগদ টাকা না-ও থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে কার্ড ব্যবহার করতে পারলে সুবিধা বাড়বে।
বিষয়টি মেনে নিয়েও কার্ড ব্যবহারের কিছু জটিলতার কথা বলছেন ওষুধ বিক্রি সংস্থার কর্তারা। একটি সংস্থার কর্তা পার্থ সমাদ্দার বলছেন, “অনলাইনে ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে কার্ড ব্যবহারের কিছু আইনি জটিলতার জন্যই এই ব্যবস্থা আমরা রাখিনি।” আর একটি সংস্থার কর্তা জগন্নাথ নস্করের দাবি, শহরের প্রবীণেরাই বেশি ওষুধের হোম ডেলিভারি নেন। তাঁরা অনলাইনে কার্ড ব্যবহারে এতটা সড়গড় নন। তাই হোম ডেলিভারির ক্ষেত্রে নগদ টাকাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন তাঁরা।
বড় সংস্থাগুলির এই পরিষেবার পাশাপাশি ইদানীং পাড়ার বড় মাপের দোকানগুলিও হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা রেখেছে। দক্ষিণ শহরতলির নেতাজিনগরের এক বাসিন্দা এ ভাবেই পাড়ার দোকান থেকে ওষুধ নেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু পাড়ার দোকানগুলি কর্মীর অভাবে সব সময়ে ওষুধ পৌঁছে দিতে পারেন না। তা ছাড়া, তাঁদের পরিষেবাও পাড়াভিত্তিক। ফলে যে পাড়ায় বড় দোকান নেই, সেখানকার প্রবীণদের পক্ষে এমন পরিষেবা পাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না।