সুভাষ হালদার ও মিঠু হালদার। —নিজস্ব চিত্র।
স্বামীর বাঁচার আশা কম। চিকিৎসকদের কাছে এটা শোনার পরেই মনস্থির করে ফেলেছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার লক্ষ্মীকান্তপুরের ঘটেশ্বর গ্রামের গৃহবধূ মিঠু হালদার। নিজের যকৃৎ (লিভার)-এর অংশ দিয়ে ক্যানসার আক্রান্ত স্বামীকে বাঁচিয়েছেন তিনি।
স্বামী অর্থাৎ সুভাষ হালদার কেক-পেস্ট্রির ব্যবসা করেন। পারিবারিক সূত্রের খবর, দীর্ঘদিন ধরেই সুভাষের ‘হেপাটাইটিস-বি’-এর চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু সারছিল না। এরই মধ্যে তিন-চার মাস আগে থেকে হঠাৎই বমি, মলের সঙ্গে রক্তপাত হতে থাকে। ক্রমেই আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন সুভাষ। তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকেরা জানান, ৪২ বছরের সুভাষের যকৃতের একটি অংশে ম্যালিগন্যান্সি ধরা পড়েছে। যকৃৎ প্রতিস্থাপন (ট্রান্সপ্লান্টেশন) ছাড়া বাঁচার আশা কম।
কিন্তু যকৃৎ প্রতিস্থাপন করা হবে বললেই তো আর তা করা যায় না! দাদা প্রদ্যোৎ দত্ত জানাচ্ছিলেন, যকৃৎ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে দাতা পাওয়া খুবই সমস্যার। দাতার সঙ্গে সুভাষের ব্লাড গ্রুপ মিলতে হবে। দেখতে হবে দাতার কোনও শারীরিক অংশ গ্রহীতার দেহে কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে কি না। গোল বেধেছিল এখানেই। সুভাষকে যক়ৃৎ দান করার জন্য দাতার যে যে শারীরিক বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার, সে রকম দাতা পাওয়া যাচ্ছিল না। ক্রমশই অবনতি হচ্ছিল সুভাষের অবস্থার। চিন্তায় পড়েছিলেন চিকিৎসকেরাও। স্ত্রী মিঠু এই সময় গোঁ ধরলেন স্বামীকে বাঁচাতে নিজের যকৃতের একটি অংশ দান করবেন। স্বামী-স্ত্রীর শরীরের বিভিন্ন উপাদান মিলে গেলেও মিলল না ব্লাড গ্রুপ। সুভাষের ব্লাড গ্রুপ ছিল ‘বি’ পজিটিভ। মিঠুর ‘ও’ পজিটিভ।
এতে বেঁকে বসেছিলেন এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। এক চিকিৎসকের কথায়, মিঠুর যকৃতের অংশটি সুভাষের যকৃতের বাদ যাওয়া অংশে বসানোর কাজটা খুব একটা সোজা ছিল না। কারণ স্বামী-স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ ছিল আলাদা। ও গ্রুপের রক্তকে বলা হয় ইউনিভার্সাল ডোনার। অর্থাৎ ও গ্রুপের দাতারা সব গ্রুপের লোককে রক্ত দিতে পারেন। গ্রুপ ছাড়াও অন্য কয়েকটি বিষয় কিন্তু মিলতে হয়। তাই এই ধরনের অস্ত্রোপচারে ব্লাড গ্রুপ পুরোপুরি না মিললে সাধারণত ঝুঁকি নেওয়া হয় না।
তা হলে এ ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপন করলেন কেন? সুভাষের অস্ত্রোপচারকারী-দলে থাকা এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘আমরা সফল হলে এটাই পূর্ব ভারতে যকৃতের ক্যানসারের ক্ষেত্রে প্রথম প্রতিস্থাপন হতো। তবুও আমরা ঝুঁকি নিতে চাইনি। সুভাষবাবুর স্ত্রী-র চাপাচাপিতেই শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচারে রাজি হই আমরা। পুরোপুরি ব্লাড গ্রুপ না মিললেও যকৃৎ প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার বিরল ঘটনা। আমরা সেখানেও সফল।’’
হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি এবং লিভার ডিজিজের বিভাগীয় প্রধান গোপালকৃষ্ণ ঢালি জানাচ্ছেন, ‘‘সুভাষের যকৃতের ডান খণ্ডে একটি অংশে ক্যানসার ধরা পড়েছিল। সেটি খুব তাড়াতাড়ি বাদ দিতে না পারলে ক্যানসার যকৃতের বাকি অংশে তো বটেই, দেহের অন্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল।’’ মূলত দু’ভাবে যকৃৎ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। আংশিক অথবা পূর্ণাঙ্গ। তবে চিকিৎসকদের আশঙ্কা ছিল আংশিক প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে আবারও দেখা দিতে পারে ম্যালিগন্যান্সি।
তাই সুভাষের যকৃতের ডান খণ্ড (লোব) পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে গোপালকৃষ্ণ জানান।
চিকিৎসক দলের অন্যতম সদস্য লিভার ডিজিজ-এর প্রধান অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘‘যকৃতের ক্যানসারের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়েই দেখা যায় টিউমার বহু জায়গায় ছড়িয়েছে। আবার যদি হেপাটিক পোর্টাল ভেনকে জড়িয়ে টিউমারটি হতো তা হলে প্রতিস্থাপন করা যেত না। সুভাষের ক্ষেত্রে সেই সমস্যাগুলি ছিল না। তাই যকৃৎ প্রতিস্থাপনে আমাদের সুবিধা হয়েছে।’’ এসএসকেএমে যকৃৎ প্রতিস্থাপন সম্পর্কে স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে বলেন, ‘‘আমাদের চিকিৎসকেরা খুব ভাল কাজ করেছেন। কিন্তু এটা নিয়ে এখনই কিছু বলার নেই। আমরা চাই রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরুন।’’
কিন্তু অস্ত্রোপচারের এই বিপুল খরচ এল কোথা থেকে?
প্রদ্যোৎ জানান, সে ক্ষেত্রেও মুশকিল আসানের ভূমিকায় দেখা যায় সুভাষের স্ত্রীকে। স্বামীকে নিয়ে মিঠু সোজা চলে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর দরবারে। সাহায্য চেয়েছিলেন স্বামীর চিকিৎসার জন্য। মিঠুদেবীকে ফেরাননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সাহায্য
করার। ফের এসএসকেএমে ভর্তি হন সুভাষ। প্রদ্যোৎ বলছিলেন, ‘‘স্ত্রীর যকৃৎ দেওয়ার ইচ্ছা এককথায়
খারিজ করে দিয়েছিলেন সুভাষ। আমরাও সবাই বারবার ভেবে দেখার কথা বলেছি। কিন্তু মিঠু না-ছোড়। ‘আর দাতা খুঁজে লাভ নেই। আমিই দেব। তোমরা কেউ বারণ কোরো না। আমার কিচ্ছু হবে না’— এই আত্মবিশ্বাসে চিকিৎসকেরাও রাজি হয়ে যান।’’
অবশেষে গত রবিবার এসএসকেএম হাসপাতালে সকাল ছ’টা থেকে শুরু হল অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি। ১২ ঘণ্টা অস্ত্রোপচারের পরে চিকিৎসকেরা বলেন, ফল সম্পর্কে তাঁরা আশাবাদী। মঙ্গলবার চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, সুভাষকে ভেন্টিলেটর থেকে বের করে আনা হয়েছে। তাঁদের দাবি, সুভাষের যকৃৎও স্বাভাবিক ভাবে কাজ
করছে। যে সব এনজাইমগুলির পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল, সেগুলি ধীরে ধীরে কমছে। মিঠুর অবস্থাও স্থিতিশীল বলে চিকিৎসকদের দাবি। তিনি আর দু’দিন পর থেকেই হাঁটাচলা করতে পারবেন বলে আশা করছেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের আরও আশা, মিঠুকে আর দিন দশেকের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হবে।
তবে সুভাষকে নিয়ে এই মুহূর্তে শতকরা ১০০ ভাগ আশ্বাস দিতে পারছেন না তাঁরা। এক চিকিৎসকের কথায়, এই ধরনের অস্ত্রোপচারে গ্রহীতার শরীর দাতার দান ঠিকমতো নিতে পারল কি না, তা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় অস্ত্রোপচারের সাত দিন পরে।
এক শল্য চিকিৎসকের কথায়, যদি গ্রহীতার দেহ দাতার অঙ্গ প্রত্যাখ্যান করতে চায়, তবে প্রথম দু’দিনের মধ্যেই তার লক্ষণ স্পষ্ট হয়। আপাতত দু’দিন পেরনোর পরেও সুভাষের দেহে তাঁর স্ত্রীর যকৃৎ প্রত্যাখ্যান করার প্রাথমিক লক্ষণ কিন্তু নেই। চিকিৎসকদের আশা, সব ঠিকঠাক চললে সুভাষকে ছাড়া হতে পারে আরও দিন কুড়ি পরে। বাড়ি ফিরে দাতা ও গ্রহীতাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে বাকি জীবনটা। এড়াতে হবে যে কোনও সংক্রমণ।
লক্ষ্মীকান্তপুরের ঘটেশ্বর গ্রামের হালদার পরিবার এখন অপেক্ষা করছে বর-বধূর জন্য।
(সহ প্রতিবেদন: সৌভিক চক্রবর্তী)