কোন মাস্ক পরলে সংক্রমণের সম্ভাবনা কম, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকেরই। ফাইল ছবি।
কেউ বলছেন এন-৯৫, কেউ বা আবার বলছেন সার্জিক্যাল মাস্ক। কেউ বলছেন সুতির মাস্কেও হবে। কাঙ্খিত মাস্ক কোনটি? এই প্রশ্নে হয়রান সবাই। আনলক পর্বে বেরোতে হচ্ছে বাইরে। তাই নাক-মুখ ঢাকা মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। পাড়ার বুটিকে দারুণ দেখতে মাস্ক কিনতে ইচ্ছে করলেও ভয় লাগছে। এদিকে যে এন৯৫ মাস্ক অনলাইনে অর্ডার করা হল, ওষুধের দোকান থেকে কেনা হল, তাহলে সেটাই কি রোজ পরতে হবে? সেটা আসল তো? এমন দ্বিধা রয়েইছে।
ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর পাট খানিকটা হলেও চুকেছে। বেরোতে তো হচ্ছেই। ভালভ রেসপিরেটর যুক্ত এন৯৫ মাস্ক কিনেছিলেন। কিন্তু ভালভ রেসপিরেটর যুক্ত মাস্ক পরে বাইরে বেরলে গোষ্ঠী সংক্রমণের একটা আশঙ্কা।তাই এই মাস্ক পরতে বারণ করা হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে। তাই বাতিল হল সেটাও। তাহলে কোন মাস্ক পরবেন সাধারণ মানুষ? ভালভ ছাড়া এন৯৫ পরলে তা যে আসল, বুঝবেনই বা কী করে?
আসল এন৯৫ মাস্ক চেনাটা সাধারণের জন্য বেশ মুশকিল। এমনটাই উল্লেখ করেছেন মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস। তিনি বলছেন, এন৯৫ মাস্ক, যেগুলিতে ভালভ রেসপিরেটর নেই, সেই মাস্কই সবথেকে ভাল। এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু বাজার এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীতে ছেয়ে গিয়েছে। মাস্কের কালোবাজারিও হচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষ সংশয়ে রয়েছেন যে কী করবেন। সে ক্ষেত্রে ত্রিস্তরীয় সার্জিক্যাল মাস্ক পরাই ভাল। তবে বিশ্বস্ত দোকান থেকে এন৯৫ কিনলে ঠকে যাওয়ার আশঙ্কা কম, এমনটাই উল্লেখ করেন অরিন্দমবাবু।
আরও পড়ুন: বাড়ি বাড়ি পরীক্ষা, সচেতনতা, কড়া লকডাউন, তবেই রাজ্যে নিয়ন্ত্রণে আসবে করোনা
''নিম্নমানের বা নকল এন৯৫ মাস্ক বাজারে ছেয়ে গিয়েছে। যা সংক্রমণ রোখার বদলে ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সরকারের তরফে প্রথমে মানুষের কথা চিন্তা করা উচিত। জনগণের কথা ভেবে মাস্ক এবং স্যানিটাইজার বিক্রিতে যাতে কোনওরকম অসাধু চক্র কাজ না করে সে বিষয়টি দেখা উচিত সরকারের। '' এমনই জানান সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী। তিনি বলেন, সার্জিক্যাল ত্রি স্তরীয় মাস্ক যেগুলি ওষুধের দোকানে পাওয়া যায়, সেগুলি ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ এ ক্ষেত্রে ঠকে যাওয়ার আশঙ্কা কম। তবে এক বারের বেশি এগুলি ব্যবহার করা কখনও যাবে না।
এন৯৫ মাস্কের কার্যকারিতা নিয়ে নানা কথা শুনে সাধারণ মানুষও এই মাস্ক বেশি করে কিনছেন।এই প্রসঙ্গে চিকিৎসক কল্লোল সেনগুপ্ত বলেছেন, চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য এই এন৯৫ মাস্ক বাধ্যতামূলক। তাঁদের জন্যও নির্দিষ্ট সংস্থার তরফে এন৯৫ মাস্ক সরবরাহ করা হচ্ছে।
ভালভ রেসপিরেটরবিহীন এন-৯৫-এ এনআইওএসএইচ মার্ক আছে কি না দেখতে হবে। ফাইল ছবি।
তাঁর মত, একমাত্র যে সংস্থা মাস্ক তৈরি করছে, তাদের ক্ষেত্রেই বলা সম্ভব যে আসল মাস্ক কোনটা। একবার হাতে নিয়েই এন৯৫ মাস্কটি আসল না নকল তা চিকিৎসকদের পক্ষেও বোঝা মুশকিল। সে ক্ষেত্রে সরকারের তরফে যদি ব্যবস্থা করে তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া যায়, তবেই এর সমাধান সম্ভব বলে উল্লেখ করেছেন কল্লোলবাবু।
বাজারচলতি অনেক মাস্কের গায়েই লেখা থাকছে এন৯৫ বা কে-এন৯৫, সেগুলো কি আসল?
৩এম এন৯৫ মাস্ক পরলে ভাল। এগুলি অনলাইন পাওয়া যায়। এরাই প্রথম আমেরিকায় এন৯৫ এনেছিল, জানালেন কল্লোলবাবু। তাঁর অভিমত, বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবর্ত হিসেবে এফএফপি-২ মাস্কও ব্যবহার করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একই উপকার হবে। মাস্ক সঠিকভাবে মুখে চেপে বসে থাকলে তবেই সেটা কাজ দেবে। যাঁরা চশমা পরেন, তাঁদের ক্ষেত্রে মাস্ক পরে নিশ্বাস ছাড়লে যদি চশমা ঝাপসা হয়ে যায়, তার মানে মাস্ক খুব ভাল সুরক্ষা দিচ্ছে না। কিন্তু হাতে দেখে বাজারচলতি মাস্ক কিনে সেটা আসল এন৯৫ কি না তা বোঝার উপায় নেই বললেই চলে।
মাস্কও ওষুধের মতো ফেয়ার প্রাইস শপ থেকে যাতে পাওয়া যায়, এন৯৫-এর সমক্ষমতা সম্পন্ন কিন্তু সাশ্রয়ী, এমন মাস্ক আনার বিষয়টি সরকারকে দেখতে অনুরোধ করেন কল্লোলবাবু। কারণ, নকল মাস্ক পরে সংক্রমণের আশঙ্কা আরও বেড়ে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আসল এন৯৫ কি না তা নিয়ে সংশয় থাকলে সেই মাস্ক কিংবা সুতির মাস্কের উপরে একটি ত্রিস্তরীয় সার্জিক্যাল মাস্ক পরে বেরোতে পারেন সাধারণ মানুষ, এমনই মত চিকিৎসকদের।
এনআইওএসএইচ অনুমোদিত এন-৯৫ মাস্কে এই বৈশিষ্ট্য থাকবে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
এন৯৫ আসল না নকল তা নিয়ে সংশয় থাকলে কী করা উচিত?
চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের মত, সাধারণ মানুষ, যাঁরা স্বাস্থ্যকর্মী নন, তাঁদের ক্ষেত্রে ত্রিস্তরীয় সার্জিক্যাল মাস্ক বা ট্রি প্লাই মাস্কই পরতে হবে। এন৯৫ পরার প্রয়োজন নেই। ওষুধের দোকানে যে সার্জিক্যাল মাস্ক পাওয়া যায়। সেটি ব্যবহার করলেই যথেষ্ট। তবে এই মাস্কের কার্যকারিতা আট ঘণ্টার মতো। তাই ব্যবহার করার পর সেটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে ফেলে দিতে হবে। এক বারের বেশি কোনওমতেই ব্যবহার করা যাবে না।
মেডিসিনের চিকিৎসক রাজর্ষি সেনগুপ্ত বলেন, ভাইরাসের আকার ৪০০ মাইক্রন। তাই এন৯৫ মাস্কে করোনা ভাইরাস রুখে দেওয়ার সম্ভাবনা ৯৫ শতাংশ। কিন্তু বাজারচলতি মাস্কে এন৯৫ লেখা মানেই যে সেগুলি ভাইরাস-রোধী, দোকান থেকে কিনলেও সেটা নিজে থেকে বোঝার উপায় নেই। একমাত্র যাঁরা তৈরি করেছেন, তাঁদের পক্ষে বোঝা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যমন্ত্রকের নির্দেশিকা মেনে মাস্ক পরলেও হবে। সরকারের তরফে চলতি বছরের এপ্রিলেই বাড়িতে সুরক্ষিত মুখাবরণী তৈরির কথা বলা হয়েছিল। বাইরে গেলেই যেমন মুখ ও নাক মাস্কে ঢেকে রাখার কথা বলা হয়েছিল। প্রতিদিন ওই মাস্ক পরিষ্কার করতে হবে, সুতির কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করা যাবে বলেও নির্দেশিকায় উল্লেখ করা হয়েছিল। পাঁচ মিনিট নুনমিশ্রিত গরম জলে ফুটিয়ে নিয়ে কাপড়টি সম্পূর্ণ শুকিয়ে মাস্ক বানানোর কথা বলা হয় তাতে। এন৯৫ মাস্কে সংশয় থাকলে বা তা না মিললে এ ভাবে মাস্ক প্রস্তুত করে নেওয়া সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে সংক্রমণ রোখার সম্ভাবনা খুব বেশি হলে ৫০ শতাংশ, এ কথা বলছেন মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দমবাবু।
ত্রি-স্তরীয় সার্জিক্যাল মাস্ক মাত্র এক বার ব্যবহারযোগ্য। ফাইল ছবি।
তবে সাধারণ মানুষের জন্য একটা আশ্বাসবাণী দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী। তিনি বলেন, মাস্ক দেখে আসল না নকল চিনতে পারলেও একটা উপায় অবশ্যই রয়েছে। সেটা হল একটি সার্টিফিকেট।আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ (এনআইওএসএইচ) দ্বারা মাস্ক অনুমোদিত কি না তা পরখ করে দেখে নেওয়া। যাঁরা এন৯৫ মাস্ক কিনছেন সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট একটি নম্বর মাস্কের গায়ে উল্লেখ করা থাকে। সঙ্গে থাকে এনআইওএসএইচের কথাও। মাস্কের গায়ে লেবেলে বা প্যাকেজেও উল্লেখ থাকে। যাঁরা প্রযুক্তির ব্যবহারে সক্ষম, তাঁরা এই সংস্থার ওয়েবসাইটে গিয়ে সেটি মিলিয়ে দেখে নিতে পারেন।
আরও পড়ুন: ক্লান্ত লাগলেই কি করোনা? উদ্বিগ্ন হবেন না, এ সব করুন
নকল মাস্কে বাজার ছেয়ে গিয়েছে, এ কথা উল্লেখ করে সুবর্ণবাবু জানান, যদি ওয়েবসাইটে গিয়ে বুঝতে সমস্যা হয় সে ক্ষেত্রে মেল করাও যেতে পারে মাস্কটি আসল কি না তা জানার জন্য। তবে চিকিৎসক অমিতাভ নন্দীর মত, ''অনুমোদিত এন-৯৫ মাস্কের লোগোও নকল করা সম্ভব। তাই যাতে মানুষের কোনওরকম ক্ষতি না হয়, সেই ভিত্তিতে সরকারের ব্যবস্থা নিতে হবে। জাত-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ যাতে সমান পরিষেবা পায়, সঠিক মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে পারে তা দেখতে হবে সরকারকেই। তবেই সংক্রমণ সম্পূর্ণভাবে রোখা সম্ভব।''
কী কী দেখলে বোঝা যাবে যে মাস্কটি আসল এন৯৫ নয়
১. ফিল্টারিং রেসপিরেটরে কোনও মার্কিং না থাকলে
২. ফিল্টারিং মাস্কে কোনও টিসি নম্বর না থাকলে
৩. ক্যাপিটাল লেটারে এনআইওএসএইচ লেখা না থাকা বা ভুল বানানে লেখা
৪. সিকোয়েন্স বা কোনও নকশাদার কাপড় ব্যবহার হলে
৫. শিশুদের এই মাস্ক ব্যবহারে সম্মতির উল্লেখ থাকলে (এনআইওএসএইচ কখনওই শিশুদের ক্ষেত্রে এ জাতীয় মাস্কের কথা বলেনি)
৬. ফিল্টারিং রেসপিরেটর মাস্কে হেডব্যান্ড থাকার কথা। ইয়ারলুপ নয়। কারণ হেডব্যান্ড থাকলেই তা মুখে চেপে বসবে। সংক্রমণের আশঙ্কা কমবে।
ভালভ রেসপিরেটরযুক্ত এন-৯৫ ব্যবহারে বাড়ে গোষ্ঠী সংক্রমণের আশঙ্কা। সতর্কবার্তা দিয়েছে কেন্দ্র। ফাইল ছবি
আরও পড়ুন: ফ্রিজ থেকে কি করোনা ছড়ায়? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা, জেনে নিন
চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মী নন, তবে রোজ রাস্তায় বেরোতে হচ্ছে, বাড়িতে এন৯৫ মাস্ক থাকলেও সেটি আসল কি না তা নিয়ে সংশয়ও রয়েছে, সে ক্ষেত্রে ত্রিস্তরীয় সার্জিক্যাল মাস্ক পরতেই পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। ভালভ রেসপিরেটরবিহীন এন৯৫ মাস্ক পরলে দেখে নিতে হবে তা অনুমোদিত কি না। তবে মাস্ক পরার সঙ্গে সামাজিক দূরত্বও মেনে চলতে হবে। বার বার হাত ধোওয়ার বিষয় মাথায় রাখতে হবে।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)