গলায় খাবার আটকালে, তা বের করতে হবে অল্প সময়েই।
রেস্তঁরায় খাবার খেতে খেতে জমিয়ে গল্প করছিলেন বন্ধুরা। আচমকা এক জনের মুখ লাল হয়ে দম আটকে এল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব শেষ। সম্প্রতি কলকাতার এক রেস্তঁরায় এমন পরিস্থিতির সামনে পড়ে হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন একদল কলেজ পড়ুয়া ও তাঁদের চেনা জানা কিছু মানুষ। মৃত ছেলেটির পরিজনেরা ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত! ঘটনাটা অবিশ্বাস্য মনে হলেও এমন দুর্ঘটনা নতুন নয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতি ২ ঘণ্টায় ১ জন মানুষ গলায় খাবার বা অন্য কিছু আটকে গিয়ে স্রেফ দম বন্ধ হয়ে মারা যান। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলে চোকিং।
শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সৌমিত্র দত্ত জানালেন, ‘‘গলায় খাবার আটকে যাওয়ার সমস্যা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শিশু আর বয়স্ক মানুষের মধ্যে। ৫ বছরের নীচে ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সের মানুষের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি। তাড়াহুড়ো করে খাবার খেতে গিয়ে বা খাওয়ার সময় কথা বলতে গিয়ে দম আটকে খুব কষ্টকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয়। খাবার শুকনো ও শক্ত হলে গলায় আটকে যাবার আশঙ্কা বাড়ে। তাই ছোট ছোট গ্রাসে খাবার খান ও খাওয়ার সময় কথা কম বলুন।’’
তবে এই সমস্যা মোকাবিলার উপায় আছে। কিন্তু বাধ্যতামূলক ভাবে তার প্রয়োগ আমাদের দেশে নেই। চিকিৎসকরা জানলেও সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টি অপরিষ্কার। অ্যামেরিকান থোরাসিক সার্জন হেনরি জে হেইমলিচ ১৯৭৪ সালে গলায় খাবার আটকে যাওয়ার তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সম্পর্কে একটি উপায় জানিয়েছিলেন। এর সাহায্যে মানুষকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যায়। পদ্ধতিটির নাম ‘হেইমলিচ ম্যানিউভার’।
শ্বাসনালীর মুখে খাবার আটকে গেলে অক্সিজেন চলাচল খুব কমে যায়। এমনকি পুরোপুরি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে দ্রুত আটকে যাওয়া খাবারের টুকরো বের না করে দিলে রোগীকে বাঁচানো যায় না। কোনও মানুষকে এই পরিস্থিতিতে পড়তে দেখলে হেইমলিচ ম্যানেউভারের সাহায্যে তাঁকে সুস্থ করে তোলা যায়, বললেন চট্টগ্রামের ইম্পেরিয়াল নারায়ানা কার্ডিয়াক সেন্টারের থোরাসিক সার্জন বিনায়ক চন্দ। অসুস্থ মানুষটিকে পিছন থেকে জড়িয়ে দুই হাত দিয়ে পেটের ওপরের দিকে জোরে জোরে চাপ দিলে শ্বাসনালীতে আটকে থাকা খাবার বেরিয়ে আসে। চিকিৎসক হেইমলিচ ৯৪ বছর বয়সে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে বৃদ্ধাবাসে থাকা সমবয়সী কয়েক জনের প্রাণ বাঁচান। ইউটিউব বা ইন্টারনেটে খুঁজলে এমন ভিডিয়ো পাওয়া যায়। যা থেকে সহজেই শিখে নেওয়া যেতে পারে এই পদ্ধতি।
শ্বাসনালীতে কিছু আটকে গেলে ফুসফুসে অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলে অ্যাস্পিক্সিয়া। শ্বাসনালী একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে, হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ক অক্সিজেনের অভাবে কাজ করতে পারে না। অবস্থা সংকটজনক হয়ে ওঠে। একে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে অ্যানোক্সিয়া। রেস্তঁরায় খেতে গিয়ে কলেজ পড়ুয়ার ক্ষেত্রে যা হয়েছিল। তবে এই ঘটনা নতুন নয়। ভারতীয় বায়ুসেনার প্রথম বাঙালি এয়ারমার্শাল সুব্রত মুখোপাধ্যায় ১৯৬০ সালে জাপানের টোকিও শহরে এক নামী রেস্তোরাঁয় বন্ধুর সঙ্গে ডিনার করতে গিয়ে গলায় খাবার আটকে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ গলায় খাবার আটকে প্রায় মৃত্যুর মুখে পৌঁছে গিয়েছিলেন। বেসবল খেলোয়াড় জিমি ফক্স বা নাট্যকার টেনিসি উইলিয়ামের পরিণতিটা ভয়াবহ হয়। গল্পগুজব করতে করতে খাবার সময় গলায় মাংসের হাড় আটকে মারা গিয়েছেন দু’জনেই। খাবার হোক বা অন্য কিছু— শ্বাসনালীতে আটকে গেলে প্রথমেই মানুষটির নিঃশ্বাসের কষ্ট হবে। কাশি, বুকের মধ্যে হাওয়ার শব্দ, বমি বমি ভাব, কথা বলতে না পারা, এ ঠোঁট নীল জ্ঞান হারানোর মত সমস্যা এর পর হতে পারে। ৭ থেকে ১২ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা শুরু না করলে রোগীকে বাঁচিয়ে তোলা মুশকিল হবে।
খাবার আটকে গেলে পিঠে চাপড় মেরে খুব ভাল কাজ হয় না। বরং হেইমলিচ ম্যানিউভার পদ্ধতিতে রোগীকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ডায়াফ্রাম অর্থাৎ পেট ও পাঁজরের সংযোগস্থলে দু’হাতে জোরে ধাক্কা দিলে আটকানো খাবারের টুকরো বেড়িয়ে আসে। এ ভাবে অনেকের প্রাণ বাঁচানো যায়।