মনের রোগকে আমরা আমল দিই না।
প্রশ্ন: সম্প্রতি এক বলিউড অভিনেতার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় আমরা সবাই আত্মহত্যা, ডিপ্রেশন ও অন্য মানসিক রোগ নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছি। এ বিষয়ে কী বলবেন?
উত্তর: মানসিক সমস্যাগুলি বরাবরই যেন আমাদের কাছে অবহেলিত। আমরা বুক ফুলিয়ে নিজের ‘ওপেন হার্ট সার্জারি’র কথা সবাইকে জানালেও সামান্য মন খারাপের কথাও সবার থেকে লুকিয়ে রাখি। যদিও মন খারাপের চিকিৎসা তুলনায় অনেক সহজ।
পরিসংখ্যান বলে বিশ্বজুড়ে ফি বছর প্রায় আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করেন। অর্থাৎ, প্রতি এক লাখে সংখ্যাটা প্রায় এগারো জন। অন্য ভাবে দেখলে প্রতি তিন সেকেন্ডে এক জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ও প্রত্যেক চল্লিশ সেকেন্ডে এক জন আত্মহত্যা করেন। আবার, আত্মহত্যার যত ঘটনা ঘটে, তার দুই-তৃতীয়াংশই উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ঘটতে দেখা গিয়েছে। দেখা গিয়েছে, আত্মঘাতী কোনও ব্যক্তি কুড়ি শতাংশ ক্ষেত্রে আগেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। ২০০৮-০৯ এর হিসাব ধরলে, বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর বিভিন্ন কারণগুলির মধ্যে আত্মহত্যা দশম স্থানে রয়েছে। এই পরিসংখ্যানগুলি জানান দেয় সমস্যা কতটা গুরুতর।
প্রশ্ন: পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কি সমান?
উত্তর: পুরুষদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঘটনা মহিলাদের তুলনায় বেশি ঘটে। যদিও মহিলারা পুরুষদের তুলনায় আত্মহত্যার চেষ্টা বেশি করেন। পুরুষেরা সাধারণত আত্মহত্যার জন্য অপেক্ষাকৃত ভয়ঙ্কর পদ্ধতিগুলির আশ্রয় বেশি নেন।
প্রশ্ন: আত্মহত্যার পিছনে কী ধরনের কারণগুলি বেশি দেখা যায়?
উত্তর: গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে আত্মহত্যার পিছনে কিছু না কিছু মানসিক রোগ বা সমস্যা যুক্ত থাকে। মন খারাপ বা ডিপ্রেশনের সমস্যা এগুলির মধ্যে অন্যতম। ডিপ্রেশন ছাড়াও আরও কিছু মানসিক রোগ, যেমন—‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’, বিভিন্ন ধরনের নেশার প্রবণতা, ব্যক্তিত্বের সমস্যা (পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার), স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া, ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার এক্টিভিটি ডিসঅর্ডার’ ইত্যাদি আত্মহত্যার প্রবণতা অনেকটাই বাড়িয়ে
দিতে পারে।
প্রশ্ন: ‘ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার’ রোগের লক্ষণ কী কী?
উত্তর: ‘ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার’ মানে কিন্তু শুধু মন খারাপ নয়। এ ক্ষেত্রে মন খারাপের সঙ্গে আরও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। যেমন—শরীরে শক্তি কমে যাওয়া, আগে যে সব কাজ করতে ভাল লাগত সেগুলিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মনোযোগের অভাব, ভুলে যাওয়া, অল্পতেই রেগে যাওয়া, নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, নিজেকে দোষী মনে হওয়া, আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা করা, ঘুম কমে বা বেড়ে যাওয়া, খিদে কমে বা বেড়ে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া ইত্যাদি। দীর্ঘদিন ধরে এমন উপসর্গগুলি চলতে থাকলে তা খারাপ কোনও পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন:‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ রোগে কী হয়?
উত্তর: ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’-এ রোগীর দু’রকম উপসর্গ দেখা যেতে পারে। কখনও উপরে বলা মন খারাপের উপসর্গ দেখা যায় আবার কখনও বা মন খুব ভাল হয়ে যায়। এই সময়ে রোগী আগে-পিছে বিবেচনা না করে অনেক বেহিসেবি কাজ করে ফেলেন। ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। অহেতুক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন, নিজেকে কেউকেটা ভাবতে শুরু করেন, ঘুম খুব কমে যায়। এই উপসর্গগুলিকে ‘ম্যানিক সিম্পটম’ বলা হয়।
প্রশ্ন: নেশার সমস্যার সঙ্গে আত্মহত্যার প্রবণতার কি সম্পর্ক আছে?
উত্তর: যে সমস্ত মানুষ নেশায় জড়িয়ে পড়েন, তাঁদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি হয়। নেশাগ্রস্ত মানুষের অনেক সময়ে মন খারাপ আরও বেড়ে যায়, নিজের উপরে স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আর এই নিয়ন্ত্রণ হারানোর ফলে আত্মহত্যার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
প্রশ্ন: ব্যক্তিত্বের সমস্যার সঙ্গে আত্মহত্যার কী ভাবে সম্পর্কিত?
উত্তর: যে সব মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঠিকমতো হয় না, তাঁরা অনেক সময়ে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়েন। ব্যক্তিত্বের সমস্যা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন— কেউ কেউ অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হন। আবেগের বশে হঠাৎ করে তাঁরা আত্মহত্যার চেষ্টা করে বসেন। কেউ কেউ আবার আশপাশের পরিবেশকে একটু অন্য চোখে দেখেন। তাঁদের কাছে মানুষ দু’রকমের হয়ে ওঠে— হয় খুব ভাল, না হলে খুব খারাপ। মানুষ যে দোষে-গুণেই সম্পূর্ণ, তা তাঁরা বোঝেন না। এঁরা নিজেদের সব সময়ে বঞ্চিত মনে করেন। সহজেই সব শেষ হয়ে গিয়েছে ভেবে নেন এবং বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন।
কেউ কেউ আবার সমস্ত কাজ বাঁধাধরা ছক অনুযায়ী করতে ভালবাসেন। নিয়মের বাইরে কিছু ঘটলে তা মানিয়ে নিতে সমস্যায় পড়েন তাঁরা। ব্যক্তিত্বের এমন নানান সমস্যা তীব্রতর হয়ে উঠলে সেগুলি মানুষকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলতে পারে।