করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে সেলাই করছেন চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী।
করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতাল
থুতনি কেটে স্কুলের সাদা জামা রক্তে ভিজে গিয়েছে। প্রায় সংজ্ঞাহীন ছেলেকে টেনে হিঁচড়ে হাসপাতালময় ছুটে বেড়াচ্ছেন মা, ‘একটু সেলাই করে দেবেন, থুতনিটা ফাঁক হয়ে গিয়েছে!’
জরুরি বিভাগে কেউ নেই। করিমপুর গ্রামীণ হাসপাতালে প্রায় আধ ঘণ্টা ছুটোছুটির পরে চিকিৎসক মিললেও রক্তাক্ত ছেলে আঁকড়ে সেনপাড়ার বাসিন্দা মিঠু মণ্ডলকে শুনতে হয়েছিল, “সেলাই? তা কি চিকিৎসকের কাজ নাকি, হাসপাতালের কোনও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীকে বলুন।” এই টানাপড়েনে সংজ্ঞা হারিয়েছিল সপ্তম শ্রেণির ওই জখম পড়ুয়া। সংজ্ঞাহীন ছেলেকে আঁকড়ে মায়ের কান্না দেখে বহির্বিভাগে আসা রোগীর বাড়ির লোকজন এ বার এগিয়ে আসেন। তাঁদের হইচই শুনেই শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। শেষতক চাপে পড়ে সেলাই করতে বাধ্য হন ওই চিকিৎসক। পরে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘‘সেলাই, ব্যান্ডেজ করার কাজগুলো তো হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীরাই করেন। এতে ভুল তো কিছু দেখছি না।’’ বেশ কয়েক মাস আগের ওই ঘটনা নিয়ে জলঘোলাও কম হয়নি। শো কজ, বিভাগীয় তদন্তও হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও করিমপুর আছে করিমপুরেই।
কাটা, ছেঁড়া বা দুর্ঘটনায় জখম কোনও রোগী হাসপাতালে এলে জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে ইঞ্জেকশন, সেলাই করার মতো যাবতীয় চিকিৎসকের কাজগুলো করে থাকেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরাই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী বলছেন, ‘‘কর্তব্যরত চিকিৎসকের পরামর্শেই সেলাই, ড্রেসিং বা ইঞ্জেকশন দেওয়ার মতো কাজগুলি আমরা করি।’’ হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ জানান, জীবন না আইন কোনটা আগে? চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা এই কাজ বন্ধ করে দিলে চিকিৎসা পরিষেবা শিকেয় উঠবে। হাসপাতালের সুপার রাজীব ঘোষ বলেন, “একজন চিকিৎসক সব সময় হাসপাতালের ডিউটিতে থাকেন। তাঁকে সব রোগীর খোঁজ নিতে হয়। তিনি অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলে কদাচিৎ ছোট ছোট সেলাই চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের করতেই হয়। এবং সেটা করতে হয় রোগীর কথা ভেবেই।”
শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল
দিনকয়েক আগের ঘটনা। মোটরবাইকের ধাক্কায় গুরুতর জখম হয়েছিলেন কৃষ্ণনগরের এক যুবক। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। জখম ওই যুবকের সঙ্গীরা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এসে চিৎকার করছিলেন, ‘‘তাড়াতাড়ি চিকিৎসককে ডাকুন।’’ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলেন একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। ‘আপনি কি চিকিৎসক’ জিজ্ঞাসে কোন জন! তখন সকলেই ব্যস্ত জখম ওই যুবককে নিয়ে। ইতিমধ্যে ওই চতুর্থ শ্রেণির কর্মী অত্যন্ত যত্ন সহকারে নিপুণ হাতে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে সেলাইও করতে শুরু করেছেন। এরপর চিকিৎসক এসে ক্ষতস্থান দেখে জানিয়ে দিলেন, ‘‘সেলাই একদম ঠিক আছে।’’
এর মধ্যে জরুরি বিভাগে চলে আসেন আর একজন রোগী। পেটের যন্ত্রণায় তিনি ছটফট করছেন। চিকিৎসক ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ওই রোগীকে নিয়ে। এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে এটাই দস্তুর। সেলাই কিংবা ইঞ্জেকশন দেওয়ার মতো যে কাজগুলো চিকিৎসকদের করার কথা, সেই কাজগুলিই করেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা। কেন?
হাসপাতালের সুপার হিমাদ্রি হালদারও মানছেন, এই কাজগুলি চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের করার কথা নয়। কিন্তু জরুরি বিভাগে একজন চিকিৎসক থাকায় তাঁর পক্ষে সবসময় সেলাই, ইঞ্জেকশন বা ড্রেসিং এর মতো কাজ করা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, ‘‘তাছাড়া বড় কোনও ঘটনা ঘটলে চিকিৎসকেরা অপারেশন থিয়েটারেই সে সব সামলান।’’
মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ
বুধবার দুপুর তখন দেড়টা থেকে দু’টো। একটি ভ্যান এসে দাঁড়াল হাসপাতালের সামনে। মোটরবাইক দুর্ঘটনায় জখম হয়েছেন মধ্য চল্লিশের এক ব্যক্তি। তাঁকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকের নির্দেশে ওই ব্যক্তির মাথার ক্ষত সেলাই থেকে শুরু করে ড্রেসিং—সবই করলেন চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী। জেলার গ্রামীণ, ব্লক কিংবা মহকুমা হাসপাতালের মতো এটাই দস্তুর জেলার একমাত্র মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও। অভিযোগ, এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সেলাই কিংবা ড্রেসিং এর মতো কাজের দায়িত্ব অনায়াসে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের হাতে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকেন চিকিৎসক কিংবা নার্সরা। এমনকী, সেলাইয়ের পরেও সেটা ঠিক মতো হল কি না সেটাও দেখার ফুরসত পান না চিকিৎসকদের অনেকেই। কিন্তু কাজটা তো বেআইনি? ‘‘রাখুন দাদা আপনাদের আইন। আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকলে মুখ পুড়বে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরই! সেলাই, ইঞ্জেকশন দেওয়ার মতো এত লোক কোথায়?’’ বলছিলেন হাসপাতালেরই এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী।
যদিও বিষয়টি মানতে নারাজ হাসাপতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের সুপার তথা সহ অধ্যক্ষ মণিময় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ড্রেসিং, সেলাই ও প্লাস্টার করার জন্য ড্রেসার পদে কর্মী রয়েছে। তবে প্রতিদিন যে হারে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে সেই কর্মী যথেষ্ট নয়। তবে অল্প সংখ্যক কর্মী দিয়েই কাজ সামাল দিতে হচ্ছে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা এমন কাজ করছেন, এমন অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে নিশ্চয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
বেলডাঙা গ্রামীণ হাসপাতাল
রাত তখন দশটা। হাসপাতালে এক মহিলা এসেছেন হাতে গভীর ক্ষত নিয়ে। ব্লেডে ডান হাতের বেশ কিছুটা অংশ কেটে গিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক নন, ছুটে এলেন হাসপাতালেরই এক চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। অত্যন্ত যত্ন সহকারে সেলাই, ব্যান্ডে়, ইঞ্জেকশনের মতো যাবতীয় কাজ তিনিই সামলে দিলেন। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শুধু প্রেসক্রিপশনে ওষুধগুলি লিখে দিলেন। দিনকয়েক আগের ওই ঘটনার পরে চতুর্থ শ্রেণির ওই কর্মী বলছিলেন, ‘‘আইন-টাইন বুঝি না। এগারো বছর ধরে হাসপাতালে আছি। চিকিৎসকদের সেলাই কিংবা ইঞ্জেকশন করা দেখতে দেখতে এখন ও সব আমার কাছে এখন জলভাত।’’
অন্যান্য হাসপাতালের মতো এখানেও চিকিৎসক থেকে নার্স সবই রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ৬ জন চিকিৎসক থাকার কথা। আছেন মাত্র ৩ জন। ফার্মাসি স্টও দু’জনের জায়গায় আছেন একজন। হাসপাতালের কর্মীরাও মেনে নিচ্ছেন, এই অবস্থায় চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্টদের অনেক কাজই সামলে দেন ওই চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরাই। হাসপাতালের সুপার দেবদত্ত বড়াল বলেন, ‘‘হাসপাতালে রোগীর চাপ মারাত্মক। ফলে কখনও কখনও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা খুব ছোটখাট কাজ করে থাকেন। তাঁরাও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ। দেখতে দেখতে অনেক কিছুই শিখেছেন। তাছাড়া এখনও পর্যন্ত তো কোনও অঘটন ঘটেনি।’’
ডোমকল মহকুমা হাসপাতাল
জমি নিয়ে বিবাদ গড়ায় সংঘর্ষে। দিনকয়েক আগে জখম ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া হল জরুরি বিভাগে। চিকিৎসক এসে শুধু প্রেসক্রিপশনে কয়েকটি ওষুধ লিখে দিলেন। তারপরেই যাঁকে ডেকে পাঠালেন তিনি ওই হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। জখম ওই যুবকের সঙ্গে আসা লোকজন অবশ্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁকে ‘ডাক্তারবাবু’ বলেই সম্বোধন করে গেলেন। একবারও বাধা দেওয়া বা ভুল শুধরে দেওয়ার রাস্তায় হাঁটলেন না চতুর্থ শ্রেণির ওই কর্মীও। তিনি মন দিয়ে যে কাজটা করে গেলেন সেটা কিন্তু আসলে চিকিৎসকেরই কাজ। হাসপাতালের সুপার প্রবীর মাণ্ডি বলছেন, ‘‘কোনও সময় চিকিৎসককে সাহায্য করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরা। এর বেশি কিছু নয়। সেলাই কিংবা ইঞ্জেকশন করছে, এমন অভিযোগ পেলে নিশ্চয় ব্যবস্থা নেব।’’
—নিজস্ব চিত্র।