ভেন্টিলেটরে রোগীকে রেখে চিকিৎসার সময় জীবনদায়ী ওষুধ সহ একাধিক বার নানা টেস্টের প্রয়োজন হয়। ছবি: শাটারস্টক
মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে ইটালিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল সদ্য চেনা মারাত্মক নভেল করোনা ভাইরাস। প্রতিদিনই কচুরিপানার মতো হু হু করে বাড়ছিল আক্রান্ত। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল মৃতের সংখ্যা। একটু শ্বাসবায়ুর জন্য খাবি খেতে খেতে শেষ নিঃশ্বাস ফেলছিলেন হাজার হাজার মানুষ। আর তখনই ভেন্টিলেটরের প্রয়োজনীয়তার কথা বুঝতে পারে আম জনতা। আমাদের দেশ তথা রাজ্যের মানুষের ধারণা, ভেন্টিলেটর আসলে টাকা রোজগারের মেশিন। এই জীবনদায়ী মেশিনটি থাকলে হয়তো বা ইটালিতে মৃতের সংখ্যা ৩৫,২২৫-তে পৌঁছতে পারত না। কোভিড-১৯ অতিমারির কালে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র ভেন্টিলেটরের প্রয়োজনীয়তার কথা সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।
ভেন্টিলেটর ঠিক কী-- এর উত্তরে ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশালিস্ট দীপঙ্কর সরকার জানালেন, সহজ ভাবে বলতে গেলে ভেন্টিলেটর হল কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র। ফুসফুসের সংক্রমণ, দুর্ঘটনা বা অন্য কোনও গুরুতর শারীরিক অবস্থায় মানুষের স্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা কমতে থাকে। এই অবস্থা চলতে থাকলে শরীরে অক্সিজেন কমে যায় ও কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে রোগীর অবস্থা আরও জটিল হয়ে ওঠে। এই সময়ে রোগীর জীবন বাঁচাতে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস প্রশ্বাস চালু রাখতে হয়, বললেন দীপঙ্করবাবু। যে যন্ত্রের সাহায্যে কৃত্রিম ভাবে শ্বাস নেওয়া যায়, তারই ডাক্তারি নাম ভেন্টিলেটর।
নভেল করোনা ভাইরাস শ্বাসনালী হয়ে ফুসফুসকে আক্রমণ করে। বেশিরভাগ মানুষেরই অল্পস্বল্প শ্বাসকষ্ট হয়, কিন্তু ৫% রোগীর মারাত্মক রকমের শ্বাসকষ্ট হয়। তাঁদের জীবন বাঁচাতে ভেন্টিলেশনে রাখা দরকার, বললেন ইন্টারনাল মেডিসিনের চিকিৎসক পুষ্পিতা মণ্ডল।
জটিল কোনও অস্ত্রোপচারে রোগীর অবস্থা সামাল দিতে ভেন্টিলেটরের সাহায্য নিতে হয়। ফাইল ছবি।
এই মুহূর্তে আমাদের দেশে ভেন্টিলেটরের সংখ্যা যথেষ্ট কম। তাই প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর-- এই আপ্তবাক্য মেনে চলা উচিত। মাস্ক পরে ও হ্যান্ড হাইজিন মেনে নভেল করোনা ভাইরাসের থেকে দূরে থাকা উচিত বলে পুষ্পিতা দেবীর পরামর্শ।
আরও পড়ুন: করোনা কতটা ক্ষতি করছে স্নায়ুতন্ত্র-মস্তিষ্কে, কী বলছেন চিকিৎসকরা
ভেন্টিলেটর এল পোলিও আক্রান্তদের জন্য
একটা সময় কোভিড ১৯ এর থেকেও মারাত্মক রোগ ছিল পোলিও। ১৯২৮ – ১৯৫২ সাল পর্যন্ত পোলিও আক্রান্তদের মৃত্যুহার ছিল অনেক বেশি। ১৯২৮ সালে বস্টনের স্কুল অফ পাবলিক হেলথের চিকিৎসক ফিলিপ ড্রিঙ্কার ও ল্যুইস অ্যাগাসিস নামে দু'জন চিকিৎসক আয়রন লাংস নামে প্রথম মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর আবিষ্কার করেন। এর অনেক পরে ১৯৫২ সালে কোপেনহেগেনে পোলিওর মহামারি শুরু হয়। সেখানকার ব্লেগদাম হাসপাতালে পোলিও আক্রান্তদের মধ্যে ৮৭% মারা যাচ্ছিলেন শ্বাসনালীর পেশি অকেজো হয়ে। সেই সময় ইয়ন ইবসেন নামে এক অ্যানেস্থেশিয়া বিশেশজ্ঞ চিকিৎসক আধুনিক ভেন্টিলেটর তৈরি করেন ১৯৫২ সালের আগস্ট মাসে। নিজের উদ্যোগে বানানো সেই ভেন্টিলেটর ব্যবহার করে এক বছরের মধ্যেই পোলিওতে মৃত্যুহার নেমে আসে ১১%-এ। তার পর প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এসেছে এখনকার অত্যাধুনিক ভেন্টিলেটর। এর সাহায্যে অজস্র মুমুর্ষু মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
কখন দরকার হয়
কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের কারণেই হোক বা অন্য কারণে, যখন মানুষ এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে নিজে শ্বাস নেবার ক্ষমতা চলে যায়, তখনই ভেন্টিলেটরের সাহায্য নেওয়া হয়। এর সাহায্যে সাময়িক ভাবে পরিস্থিতির সামাল দিলে অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়।
দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হলে, নিউমোনিয়া, সিওপিডি-সহ বিভিন্ন ফুসফুসের অসুখ হলে, সেপ্টিসিমিয়ার মতো সাংঘাতিক কোনও সংক্রমণ হয়ে রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়ে পড়লে, সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক বা ব্রেন স্ট্রোক হলে, বিষাক্ত সাপে কামড়ালে,জটিল কোনও অস্ত্রোপচারের সময় রোগীর অবস্থা সামাল দিতে ভেন্টিলেটরের সাহায্য নিতে হতে পারে, বলে জানালেন দীপঙ্কর সরকার। মোদ্দা কথা, শরীরে যখন অক্সিজেনের মাত্রা খুব কমে যায় একই সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়, তখনই ভেন্টিলেটরের সাহায্যের দরকার হয়। দীপঙ্করবাবু বললেন, গুলেনবেরি সিন্ড্রোমের মত কিছু অসুখে যখন শরীরের মাংসপেশি অত্যধিক দুর্বল হয়ে যাওয়ার জন্যে নিশ্বাস নেওয়ার ক্ষমতা চলে যায় সেই সময়েও কৃত্রিম ভাবে শ্বাস চালু রাখার জন্যে ভেন্টিলেটরের সাহায্য নিতে হয়।
ভেন্টিলেটর মৃতপ্রায় রোগীকেও বাঁচিয়ে তোলে
মুমুর্ষু মানুষকে জীবন ফিরিয়ে দিতেই ভেন্টিলেটরের সাহায্য নেওয়া হয়। কখনও কখনও সাময়িক ভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে ভেন্টিলেটরের সাহায্য নেওয়া হয়। আবার অনেক সময় বছরের পর বছর রোগীকে ভেন্টিলেটরে রাখতে হতে পারে (প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সীর ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছিল)।
রোগী ভেন্টিলেটর থেকে সুস্থ হয়ে বেরিয়ে আসতে পারবেন কিনা তা নির্ভর করে সার্বিক শারীরিক অবস্থার উপর। ফাইল ছবি
বেশির ভাগ মানুষের মনে এই প্রশ্ন ওঠে যে, এই কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের সাহায্য নিলে রোগীর ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটা। দীপঙ্করবাবু বললেন, রোগী ভেন্টিলেটর থেকে সুস্থ হয়ে বেরিয়ে আসতে পারবেন কিনা তা নির্ভর করে মানুষটির সার্বিক শারীরিক অবস্থার উপর। অনেক ক্ষেত্রেই রোগী ভাল হয়ে ওঠেন। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ভেন্টিলেটরে রোগীকে রেখে চিকিৎসা করার সময় জীবনদায়ী ওষুধ সহ একাধিক বার নানা টেস্ট করানোর প্রয়োজন হয়। ব্যাপারটা যথেষ্ট খরচ সাপেক্ষ। তাই রোগীর নিকটজনের সম্মতি নিয়ে তবেই রোগীকে ভেন্টিলেটরে দেওয়া হয়, বললেন পুষ্পিতা মণ্ডল। খরচের ধাক্কা সামলাতে না পারলে অনেকে ভেন্টিলেটর থেকে রোগীকে বার করে দিতে অনুরোধ করেন। ইচ্ছে হলেই রোগীকে ভেন্টিলেটর থেকে বাইরে আনা যায় না।
আরও পড়ুন:স্পুটনিকে জব্দ কোভিড ১৯? কী বলছেন চিকিৎসকরা
রোগী সুস্থ হলে কিংবা মারা গেলে তবেই তাঁর এই জীবনদায়ী মেশিন খুলে দেওয়া যায়, এটাই আইন। তবে একটা ব্যাপার জেনে রাখা উচিত, মানুষ মারা যাওয়ার পর তাকে ভেন্টিলেটরে রেখে বিল বাড়ানোর গল্পটা একেবারে মনগড়া। কেন না, ভেন্টিলেটর শুধুমাত্র শ্বাস প্রশ্বাস চালু রাখতে পারে। মানুষ মারা গেলে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। ভেন্টিলেটরের সংখ্যা অনেক কম, বেসরকারি হাসপাতালের খরচও আকাশছোঁয়া। তাই হাত সাবান দেওয়া ও মুখে মাস্ক পরার নিয়ম মেনে কোভিড-১৯-কে আটকে দিন, ভাল থাকুন।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)