রোগটার সংক্ষিপ্ত নাম লুপাস। পুরো নাম সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমাটোসাস (এসএলই)। এটি একটি ক্রনিক অটো-ইমিউন রোগ। একবার হলে মৃত্যু পর্যন্ত ওষুধ খেয়েই যেতে হয়। চিকিৎসকদের মতে, লুপাস সেরে যায়—এই ধারণা কোনও রোগীকে না দেওয়াই ভাল। তবে ওষুধ ঠিকমতো খেলে রোগী ভাল থাকতে পারেন, তেমন দৃষ্টান্তও রয়েছে।
রোগটির গোড়ার কথা
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা.অরুণাংশ তালুকদারের কথায়, ‘‘সিস্টেমিক লুপাস এরিথেমাটোসাস কথাটির গুরুত্ব রয়েছে। সিস্টেমিক অর্থাৎ শরীরের একটি অঙ্গে নয়, একাধিক অঙ্গে এই রোগের প্রভাব দেখা যেতে পারে। লুপাস কথাটির মানে প্রদাহ। আর এরিথেমাটোসাস কথাটির মানে লাল হয়ে ফুলে যাওয়া।’’ এটি অটো-ইমিউন রোগ অর্থাৎ যখন কোনও ব্যক্তির অঙ্গের কোষের রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে এবং তারা শরীরের ইমিউন বা রোগপ্রতিরোধকারী কোষগুলিকে আক্রমণ করে। লুপাস এক দিনে হয় না। ধীরে ধীরে এর উপসর্গগুলি প্রকট হয়।
কেন হয় এসএলই?
ডা. তালুকদারের মতে, এটি বংশানুক্রমিক রোগ নয়। মায়ের থাকলে ছেলে বা মেয়ের হবে, এমনটাও নয়। তবে যদি এমন হয়ে থাকে, সেটা নেহাত কাকতালীয়। এটি ছোঁয়াচে রোগও নয়। কয়েকজনের মতে, রোদে বেশি থাকলে এই রোগের সম্ভাবনা বাড়ে। কিন্তু সেটাও ঠিক নয় বলে মত চিকিৎসকের। ‘‘লুপাসের কুড়িটি কেস এলে, তার মধ্যে আঠেরো বা উনিশটি মহিলাদের। একটি বা দু’টিই পুরুষদের। কুড়ি থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সি মহিলাদের এই রোগ হওয়ার প্রবণতা বেশি। সেখান থেকেই গবেষকদের অনুমান, এই রোগের সঙ্গে সেক্স হরমোনের সম্পর্ক থাকতে পারে,’’ বললেন ডা.তালুকদার।
উপসর্গ
লুপাসের একটি অতি সাধারণ এবং বহুল প্রচলিত উপসর্গ, মুখে লাল রঙের র্যাশ বেরোনো। কপাল, নাকের চারপাশ এবং গালে লালচে রঙের র্যাশ বেরোয়। চামড়াও খানিক ফুলে থাকে। একে বলা হয় বাটারফ্লাই র্যাশ। রোদের সংস্পর্শে এলে এই অংশটি আরও লাল হয়ে যায়। জ্বলুনি এবং চুলকানি বাড়ে। ডা.তালুকদারের কথায়, ‘‘ল্যাটিন ভাষায় লুপাস কথাটির অর্থ উল্ফ বা নেকড়ে। উল্ফের নাকের চারপাশে ওরকম লালচে আভা থাকে বলেই সেখান থেকে এই রোগের নামকরণ করা হয়েছে।’’
এ ছাড়াও ত্বকের অন্য জায়গায় ফোসকা বা র্যাশ হতে পারে। চুল উঠে যেতে পারে, চুলের গোড়া শুষ্ক হয়ে যেতে পারে। নখের গোড়ায় পরিবর্তনও আসতে পারে।
জ্বর এই রোগের একটি অতি সাধারণ উপসর্গ।
এই রোগ লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে দেয়। যার ফলে এই ধরনের রোগীদের রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া দেখা যায়। রক্ততঞ্চন হওয়ার ফলেও চামড়ার কোথাও কোথাও লাল ছোপ দেখা যেতে পারে।
এ ছাড়া আরও একটি সাধারণ উপসর্গ হল, দেহের ছোট-বড় যে কোনও জয়েন্টে ব্যথা হওয়া। ব্যথার তীব্রতা এতটাই বাড়ে যে, রোগী হাত-পা চালাতে অসুবিধে বোধ করতে পারেন।
হার্ট, ফুসফুস, কিডনি এবং সর্বোপরি মস্তিষ্কেও লুপাসের প্রভাব পড়তে পারে। হার্ট আক্রান্ত হলে হার্ট ফেলিয়োরের সম্ভাবনা বাড়ে। লাংসে হলে নিউমোনিয়া হতে পারে। বাকি উপসর্গগুলির সঙ্গে খিঁচুনির উপসর্গ থাকলে বুঝতে হবে, মস্তিষ্ক এসএলইতে আক্রান্ত হয়েছে।
ডা.তালুকদার ধরিয়ে দিচ্ছেন, শুধু ত্বকে লুপাস হলে, সেটিকে বলা হয় স্কিন লুপাস। তবে লুপাস সাধারণত একসঙ্গে একাধিক অঙ্গেই হয়। চামড়ার পরেই যে অঙ্গটি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়, সেটি হল কিডনি। সকলের যে সব ক’টি উপসর্গ থাকবে এমন নয়। তবে একসঙ্গে হার্ট-কিডনি-লাংসে হলে, রোগীর শারীরিক অবস্থা বেশ গুরুতর বুঝতে হবে।
রোগ নির্ণয়
চামড়ার পরিবর্তন এবং র্যাশের মতো উপসর্গ দেখে সাধারণত চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে প্রথমে যান রোগী। তবে এটি ত্বকের রোগ নয়। তাই সেখান থেকে রেফার করা হয় মেডিসিনের চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য।
চামড়ায় র্যাশের উপসর্গ দেখে চিকিৎসকেরা প্রথমে রক্তের কয়েকটি পরীক্ষা দেন।
ইউরিন টেস্ট এবং কিডনির বায়োপ্সি করা হয়। এই টেস্টের রিপোর্ট দেখে এসএলই কোন স্টেজে রয়েছে বা কেমন ওষুধ দেওয়া হবে, তা বুঝতে পারেন চিকিৎসকেরা।
লুপাসে আক্রান্ত হলে সন্তানধারণ করতে পারবেন কোনও নারী?
ডা. তালুকদারের মতে, ‘‘যে মহিলাদের একটি সন্তান রয়েছে, তাদের দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার জন্য সাধারণত বারণ করা হয়। লুপাস রোগীকে যে ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়, তা গর্ভস্থ সন্তানের উপরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে যদি একটি সন্তানও না থাকে, সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতির নিরিখে ঝুঁকি নিয়েই সন্তানধারণ করার কথা বলা হয়। তখন রোগীকে ক্লোজ় মনিটর করার প্রয়োজন রয়েছে।’’
চিকিৎসা
এসএলই রোগ হলে রোগীকে বিভিন্ন ওঠাপড়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। চিকিৎসকের মতে, এই রোগের তীব্রতা কখনও কখনও এমন বেড়ে যায় যে, রোগী বিছানা ছাড়তে পারেন না। আবার তীব্রতা কমলে, তিনি কয়েক মাস হয়তো নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে কাটালেন। অর্থাৎ রোগের একটি কার্ভ রয়েছে, যেখানে সময়ে সময়ে ঢেউ বা ওয়েভ আসে।
বিভিন্ন ওষুধের মধ্যে স্টেরয়েড প্রয়োগ করা হয় এই ধরনের রোগীদের জন্য। তবে কাকে কতটা পরিমাণ দেওয়া হবে তা নির্ভর করছে রোগের মাত্রার উপরে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি ইঞ্জেকশনও প্রয়োগ করা হয়।
লুপাস সারে না। তবে তা হলে ভয় পাবেন না। কারণ আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে এই রোগ যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।