বিয়েবাড়ির ভোজের এ কাল-সে কাল। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
আগামী ১৫ ডিসেম্বর (২৯ অগ্রহায়ণ) চার হাত এক হতে চলেছে ঋষভ সাহা আর হিয়া দাশগুপ্তর। পেশায় দু’জনেই চিকিৎসক। উত্তরপ্রদেশের এক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পড়তে গিয়ে আলাপ, তার পরেই শুরু প্রেমপর্ব। যে কোনও বিয়েবাড়িতেই খাওয়াদাওয়াটা কেমন ছিল, তা হয়ে যায় অত্যন্ত জরুরি। সে কথা স্বীকার করছেন পাত্র ঋষভ। তিনি বলেন, ‘‘ভোজনরসিক বাঙালি আর কিছু মনে রাখুক বা না-ই রাখুক, বিয়েবাড়ির শেষে খাওয়াদাওয়াটা কেমন ছিল সেই নিয়ে চর্চা করবেই করবে। তাই বিয়ের তারিখ পাকা হতেই আগে কেটারিংয়ের দায়িত্ব কাকে দেব সেটা ঠিক করে ফেলেছিলাম এক বছর আগেই। আমাদের বৌভাতের অনুষ্ঠানে প্রায় ৬০০ জন অতিথি আসবেন। পরিবারের লোকজন ছাড়াও, পাড়ার অবাঙালি প্রতিবেশী, উত্তরপ্রদেশের কলেজের বন্ধুবান্ধব, অফিসের সহকর্মী— সবাই রয়েছেন সেই তালিকায়। তাই সকলেই যেন খাওয়াদাওয়া সমান ভাবে উপভোগ করতে পারেন, সেটা মাথায় রেখেই বিয়ের মেনুটা ঠিক করেছি।’’
মেনুতে কী কী রেখেছেন?
বিয়ের মেনুতে প্রথমেই থাকছে মকটেল কাউন্টার, রংবেরঙের শরবত মিলবে সেখানে। আর শীতকালে বিয়ে হচ্ছে, তাই স্যুপ কাউন্টার আর চা-কফির কাউন্টার থাকছে। এর পরে থাকছে চাট কাউন্টার, ফুচকা, দই ফুচকা, রাগড়া চাট, বেনারসের বিখ্যাত টম্যাটো চাট-ও পাবেন সেই কাউন্টারে। মোট ৮ রকমের স্টার্টার থাকছে মেনুতে। পনির-কর্ন টিক্কা, হরাভরা কবাব, তন্দুরি মাশরুম, গলৌটি কবাব, ফিশ ওরলে, প্রন ককটেল, আরও কত কী! মেন কোর্সে ৪ থেকে ৫ রকম রুটি, ডাল মাখানি, কড়াই পনির, মটন কালাভুনা, চিকেন চাঙ্গেজ়ি, প্রন লাবাবদার, চিতল মাছের মুইঠ্যা। শেষপাতে মিষ্টিমুখের জন্য থাকছে নলেন গুড়ের সুফলে, পাটিসাপটা, রাবড়ি-জিলিপি আর কুলফি।
আয়োজন এলাহি আগেও ছিল, এখনও আছে। ছেলেমেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে বাবা-মায়েরা খাওনদাওন নিয়ে কখনওই আপস করতে চান না। তবে বিগত পাঁচ-ছ’বছরে বিয়েবাড়ির ভোজ ও পরিবেশনে খানিকটা বদল এসেছে বইকি। বেড়েছে জাঁকজমক, চাকচিক্যের পাশাপাশি মেনুতেও এসেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া।
আয়োজন এলাহি আগেও ছিল, এখনও আছে। ছবি: সংগৃহীত।
এ মরসুমে বিয়ের ভোজে নতুন কী থাকছে?
বদল এসেছে, তবে সাবেকিয়ানার তালে তাল মিলিয়ে, এমনটাই মত ৬ বালিগঞ্জ প্লেসের শেফ সুশান্ত সেনগুপ্তর। শেফ বলেন, ‘‘বিয়েবাড়ি মানেই তো সাবেকি আয়োজন। বছরের পর বছর ধরে বিয়ের ভোজেও তাই থেকে গিয়েছে সাবেকিয়ানা। তবে দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে সাবেকিয়ানার সঙ্গে খানিকটা ফিউশন ‘টাচ্’ও যুক্ত হয়েছে। গ্রাহকেরা সাবেকিয়ানার মধ্যেও নতুন কিছু খুঁজছেন। অনেকেই দাবি করছেন, আর পাঁচজনের থেকে যেন তাঁদের বিয়েবাড়ির মেনুটা আলাদা হয়। ডিসেম্বরেই একটা বিয়ের মেনুতে আমরা রেখেছি টাকি মাছের ভর্তা, বকফুল ভাজা, চিংড়ি মাছের সালমি, বোনলেস ভাপা ইলিশ, হেতুমারি লাল চালের ভাত, কষা মাংসের মতো পদ। মিষ্টিমুখের জন্য থাকছে মালপোয়া চিজ় কেক, গন্ধরাজ প্যানাকডা। ইদানীং আমাদের মেনুতে থাকা কুল্লার ওয়ালি বিরিয়ানি বেশ পছন্দ করছেন গ্রাহকেরা। মেনুতে মটন বিরিয়ানি, কবাব চাই এমন গ্রাহকও যেমন আছেন, তেমনই অনেকেই আছেন যাঁরা ৬ বালিগঞ্জ স্পেশ্যাল গন্ধরাজ মুরগি, ফিশ ফ্রাইয়ের মতো চেনা পদগুলি মেনুতে রাখতে চান। খাবারের মেনুটা পুরোটাই নির্ভর করে গ্রাহকের চাহিদা ও বাজেটের উপর। মানুষের ভাল লাগায় যেমন বদল আসবে, বছর বছর তার প্রভাব পড়বে মেনুর উপরেও।’’
কী বলছে তরুণ প্রজন্ম?
বছর সাতেক হল বাবার সঙ্গে ব্যবসায় যোগ দিয়েছেন ‘সুইট অ্যান্ড সাওয়ার’ কেটারিংয়ের অন্যতম কর্ণধার আরণ্যক ঘোষ। আরণ্যক বলেন, ‘‘আগে আমি দেখতাম বিয়ের মেনুতে কী থাকবে তা ঠিক করতেন বাড়ির বাবা-জেঠুরা। তবে এখন কিন্তু বর-কনে নিজেই এসে আমাদের কাছে মেনু ঠিক করেন। মেনুতে এখন যে বদলটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সেটা কিন্তু খানিকটা সেই কারণেই। তরুণ প্রজন্ম তাঁদের পছন্দকে গুরুত্ব দিচ্ছে বিয়ের মেনুতে। এ ছাড়া এখন বিয়ের মেনু কিন্তু অনেক বেশি স্টার্টার আর লাইভ কাউন্টার নির্ভর হয়ে পড়েছে। কোনও কোনও ইভেন্টে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী আমাদের ৩০ থেকে ৪০টি স্টার্টার পদ রাখতে হয়। মেনকোর্স এখন খানিকটা হলেও অবহেলিত। স্টার্টারের পর এখন মিষ্টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন গ্রাহকেরা। প্রায় ১০ থেকে ২০ শতাংশ তরুণ প্রজন্মের বর-কনে এখন বাঙালি, মোগলাই, চাইনিজ়, কন্টিনেন্টাল খাবারের পাশাপাশি জাপানিজ়, মোঙ্গলিয়ান, ইটালিয়ান খাবারও মেনুতে রাখতে চাইছেন। এটা ঠিক যে, বাঙালি বিয়ের মেনুতে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে পিৎজ়া, সুশি, বাও, শাওয়ারমা, তবে সাবেকি মেনুকে সরিয়ে নয়। ইদানীং আরও একটা বদল এসেছে স্যালাড কাউন্টারে। আগের তুলনায় এখন মানুষ অনেক বেশি স্বাস্থ্যসচেতন হয়েছেন। তাই স্যালাড কাউন্টারে স্যালাডের পদও দিন দিন বেড়ে চলেছে। থাকছে টাটকা কাটা ফলও। আগামী দিনে বিয়ের ভোজের মেনুতে স্যালাডের গুরুত্ব আরও বাড়বে বলেই আমার মনে হয়।’’
মেনকোর্স এখন খানিকটা হলেও অবহেলিত। ছবি: সংগৃহীত।
ভালবেসে বিয়ে
বিয়ের মেনুতে এখন যে বদল এসেছে, তার নেপথ্যে আরও বেশ কিছু কারণ রয়েছে। গুপ্তা কেটারারের কর্ণধার সন্দীপ গুপ্তা বলেন, ‘‘এখন ভিন্বর্ণ, ধর্ম, জাতে বিয়ে করার চল বেড়েছে। বাঙালি কনে বিয়ে করছেন পঞ্জাবি বরকে, তামিল ব্রাহ্মণ পাত্র ভালবেসে বিয়ে করছেন মাড়োয়ারি পাত্রীকে। মেনুতেও কিন্তু সেই প্রভাব পড়ছে। সব ধরনের খাবারই রাখতে হচ্ছে তখন মেনুতে। বাঙালি বিয়ের ভোজে আপ্পাম, ইডলি, দোসাও রাখতে হয়েছে আমাদের।’’
বেড়েছে জাঁকজমক
বিয়েবাড়িতে এখন চাকচিক্য অনেক বেড়ে গিয়েছে। দক্ষিণ কলকাতা ক্যাফে দার্জিলিং-এর কর্ণধার দেবু ভট্টাচার্য কেটারিংয়ের ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত দীর্ঘ দিন ধরে। তিনি বলেন, ‘‘খাবার গুণমান কেমন সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই এখন কী ভাবে সেই খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে সেটার দিকে নজর দিচ্ছেন গ্রাহকেরা। একটা সময় ছিল যখন বিয়েবাড়িতে বাড়ির লোকেরাই অতিথিদের খাবার পরিবেশন করতেন। এখন কখনও শেফের পোশাকে, কখনও ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ছেলেমেয়েরা খাবার পরিবেশন করছেন। চেয়ার-টেবিলে বসে খাওয়াদাওয়া নয়, এখন বুফে কাউন্টারগুলির সাজগোজের দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে বেশি। জাঁকজমক যত বাড়বে, ততই বাড়বে প্লেটপিছু খরচ। এখন এলাহি আয়োজনের জন্য গ্রাহক বাড়তি খরচ করতেও প্রস্তুত। লাইভ কাউন্টারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।’’
এক ঝলকে বিয়ের ভোজের এ কাল-সে কাল
চায়ের সঙ্গে ‘টা’: ‘টা’ অর্থাৎ পানীয়ের যোগ্য সঙ্গত। পানীয়ের সঙ্গে স্ন্যাকস না থাকলে জমে? এখন অবশ্য আমিষ- নিরামিষ পকোড়ার বদলে বিয়ের মেনুর স্টার্টারে থাকছে তন্দুরি আইটেম বা কবাব জাতীয় খাবার। স্বাদবদলের জন্য থাকছে মোমো, ওয়ানটন, গোল্ডেন ফ্রায়েড প্রন, পাস্তা, নুডল্স, স্যাসলিক, শাওয়ারমার মতো রকমারি পদ। সঙ্গে জুড়েছে চাট কাউন্টার, স্যুপ কাউন্টার, মকটেল কাউন্টার।
মাঝ ভোজনে: প্রথম পাতে বেড়েছে রুটির সংখ্যা। বেবি নান, কুলচা, কড়াইশুঁটির কচুরি, তাওয়া পরোটা, আরও কত কী! সঙ্গে মরসুম অনুযায়ী কড়াই পনির, ডাল মাখনি, অমৃতসরি ছোলের মতো নিরামিষের দু’টি-তিনটি পদ। তার পর একটা ফ্রাই আইটেম। বিরিয়ানি হলে সঙ্গে চিকেনের কোনও গ্রেভি। আর স্টিম্ড রাইস বা পোলাও হলে ভেটকি পাতুরি, চিংড়ি মালাইকারি, মটন রোগানজোশ। এখানেই ইতি নয়, এর পাশাপাশি চেখে দেখতে হবে কখনও চাইনিজ় কাউন্টার, কখনও ইটালিয়ান কাউন্টার,কখনও আবার মঙ্গোলিয়ান কউন্টারের দেশ-বিদেশের রন্ধনশৈলী।
মিষ্টিমুখ: বিয়েতে মিষ্টি বাছাইয়ের বিষয়টা অনেকটা ঠিক জহুরির সোনা বাছাইয়ের মতো। মিষ্টি ঠিকঠাক না হলে খাওয়ার আনন্দটাই মাটি। রসগোল্লা বা সন্দেশের পাশাপাশি মিষ্টির পাতে চমক দিতে রাখতে পারেন বেক্ড রসগোল্লা, বেক্ড মালপোয়া, রাবড়ি-জিলিপি বা গরম গোলাপজামুনের মতো সুস্বাদু মিষ্টি । মেনুতে ইদানীং ঠাঁই পায় ফিউশনধর্মী রকমারি মিষ্টিও।
শেষপাতে বাজিমাত: বিয়ের শেষপাতে আইসক্রিম এখনও কিন্তু তোফা! তবে মেনুতে একটু বদল আনতে চাইলে রাখুন আম কুলফি, অরেঞ্জ কুলফি, কাস্টার্ড পুডিং বা হট চকোলেটের মতো পদ। আর সব শেষে মুখশুদ্ধিতে লবঙ্গ সহযোগে বেনারসি পানটা নিতে হবে পানের লাইভ কাউন্টার থেকে। এখন অবশ্য সেই কাউন্টারে আগুন নিয়ে অনেক রকম কীর্তিকলাপও হচ্ছে, তাই সাবধান!
বিয়ের ভোজে গুরুত্ব বাড়ছে স্যালাডের। ছবি: সংগৃহীত।
বিয়েবাড়িতে এখন আর দেখা যায় না সেই সব ‘খাইয়ে’ মানুষদের। যাঁরা গোটা বিশেক মাছের টুকরো বা খান পঞ্চাশ রসগোল্লা অনায়াসে খেয়ে নিতেন বিনা ক্লান্তিতে। তাঁরাও হারিয়ে গিয়েছেন সে কালের বিয়ের ভোজের মতো। চমকদারি না থাকলেও সে ভোজে আন্তরিকতার স্পর্শ থাকত। আর আসন, চাটাই পেতে খাওয়াদাওয়া হত বাড়ির দালান বা ছাদে। খাওয়া হত কলাপাতায় আর জল দেওয়া হত মাটির গ্লাসে। লুচি বা কড়াইশুঁটির কচুরি, কুমড়োর ছক্কা, ডাঁটি সমেত বেগুনভাজা, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, মাছের কালিয়া, পাঁঠার মাংস। নিতান্ত অভাবের সংসারেও মেয়ের বিয়েতে ভাত, ডাল, ভাজা, শুক্তো, ডালনা, মাছের ঝোল খাওয়ানো হত গ্রামের বাড়ির অতিথিদের। এখন খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব পুরোটাই পড়ে বিভিন্ন কেটারিং সংস্থার উপর। বাড়ির লোকেদের উপর দায়িত্বভার কম। তবে এখন পরিবারে কারও বিয়ে হলে বয়স্ক মানুষেরা আনন্দের সঙ্গে কিছুটা স্মৃতিবিজড়িত হয়ে পড়েন। তাঁদের মনের স্মৃতির কুঠুরিতে আজও উঁকি দেয় বাঙালি বিয়ের সে কাল ও এ কাল।