ঘরের মাঝে ঘোরানো সিঁড়ি
রুপোলি পর্দার স্বপ্ন মেখে হাওড়া থেকে ছেলেটি কলকাতায় এসেছিল প্রায় দু’দশক আগে। মেসের ঘরে গাদাগাদি করে সে দিন কাটাত পরের দিনটার দিকে তাকিয়ে... সেই রুদ্রনীল ঘোষের অনেক স্বপ্নের মধ্যে নিজের তৈরি বাড়ির স্বপ্নও ছিল। উপার্জন শুরু করার পরে মুর অ্যাভিনিউয়ের ছ’শো স্কোয়্যার ফুটের প্রথম ফ্ল্যাট। আরও একটু স্বাচ্ছন্দ্য, আরও একটু ঝুঁকি নেওয়ার তাগিদ থেকেই বছর চারেক আগে খোদ স্টুডিয়োপাড়ায় ২০০০ বর্গফুটের পেল্লায় ডুপ্লে কিনে ফেলা। ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়ো থেকে হাঁটা দূরত্বে এখন থাকেন রুদ্রনীল, প্রতি ইঞ্চি নিজের হাতে সাজিয়ে তোলা তাঁর স্বপ্নের ঠিকানায়।
ফ্ল্যাট বাছাই পর্বে বহু বহুতলই মনে ধরেনি তাঁর। একটু মাটির কাছাকাছি থাকতে চাওয়া, সবুজের নিরিবিলিতে বসে আঁকাজোকা করার অবকাশ চাওয়া অভিনেতা এমন কোথাও বাসা বাঁধতে চেয়েছিলেন, যেখানে আলো-বাতাস-সবুজের পাশাপাশি যাতায়াতও সহজ হবে। এক মেরিন ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি কেনেন, শুধু পিলারগুলো রেখে পুরোটাই ভেঙে ফের নতুন করে গড়েন। চারটি ঘর, দু’টি স্নানঘর ভেঙে বানান তিনটি ঘর, তিনটি বাথরুম। ডাইনিং রুমের মাঝ বরাবর পাক খেয়ে উঠে যাওয়া লোহা ও কাঠের ফিনিশিংয়ের সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছনো যায় ডুপ্লের উপরমহলে। সেখানে তাঁর স্টাডি, ওয়র্কস্টেশন, ঘর-লাগোয়া একফালি খোলা ছাদ। এ বাড়ির সব জানালাই এসে শেষ হয়েছে ফ্লোরে, যা খুললে দমকা বাতাস আর আলো এসে ঝলমলিয়ে দেয় তাঁর লিভিংরুম, বেডরুমকে।
কেনার পরের আট মাস ধরে সাজিয়েছেন ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণ। কোনও ইন্টিরিয়র ডিজ়াইনারের সাহায্য নেননি। বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন যে আঁকার হাত, তারই সদ্ব্যবহার করে শুটিং চলাকালীন ফোনে একের পর এক ডিজ়াইন এঁকে পাঠাতেন। আর সেই মতো দেওয়াল, মেঝে, প্রতিটি ফ্রেমের চুলচেরা খেয়াল রেখে অন্দর সাজানোয় হাত মিলিয়েছিলেন অভিনেতার দুই অনুজপ্রতিম, শিবাজি পাল এবং দেবাশিস গোস্বামী। ঘরের বেশির ভাগ আসবাবই কাঠ ও ব্রাসের মিশেলে, কারণ এই কম্বিনেশন তাঁর বিশেষ পছন্দের। চেয়েছিলেন, এথনিকের সঙ্গে আধুনিক মিলিয়ে ঘরে ফিউশন ফিল আনতে। অথচ মাথায় ছিল ঘরগুলির ডেকরে যেন সাযুজ্য থাকে, এক ঘর থেকে অন্য ঘরে প্রবেশ যেন ‘জাম্পকাট’ না হয়।
ডাইনিংয়ে উডেন সিলিং
তাঁর অন্দরসজ্জায় জায়গা করে নিয়েছে কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল থেকে রেড-ইন্ডিয়ান ট্রাইবাল আর্টের পেঁচার শো-পিস। মায়ের কেনা জয়পুরী কাজ করা কাঠের হাফ-কাবার্ডের উপরে কম্পিউটার-প্রিন্টার রেখে ওয়র্কস্টেশন বানিয়েছেন যেমন, তেমনই আবার বেডরুমে রেখেছেন সাহেবি কেতার ড্রেসিং টেবল। অবশ্য সব আসবাবেই রয়েছে অভিনেতার ‘ইন্ডিজেনাস টাচ’, অর্থাৎ নিজের মতো করে গড়ে নেওয়ার চেষ্টা। ধবধবে সাদা ড্রেসিং টেবলের চেয়ারের পিঠে শোভা পাচ্ছে অড্রে হেপবার্নের সিগনেচার পোজ়, আয়নার বাঁ-দিক বেয়ে নেমে এসেছে দু’টি সাবেকি কাঠের পিলার, বেডরুমের পালঙ্কের ছত্রিগুলির সঙ্গে মিলিয়ে। বেডরুমে ঢুকলেই আরাম পাবে চোখ, কারণ সেখানে ‘হোয়াইট ব্যালান্স’ নিয়ে খেলা করেছেন ডিজ়াইনার রুদ্রনীল। বেডরুমের সিলিং থেকে চার দেওয়াল পুরোটাই হোয়াইট, উডেন। এমনকি পাখার ব্লেডগুলিও! পালঙ্কের সোজাসুজি রাখা একটি কাউচ যেন মনে করাবে ব্রিটিশ পিরিয়ডকে। কাউচের এক পাশে খোলা জানালা, আর তার ঠিক সামনেই বিনোদনের বন্দোবস্ত। দেওয়ালজোড়া টেলিভিশন স্ক্রিন, বসার ঘরের টিভির পাশে সাজিয়ে রাখা হরেক রকম শো-পিসের মাঝে নজর কাড়ছে এক পেল্লায় বুদ্ধমূর্তি। কোনও হিল্লি-দিল্লি নয়, নিজের হোমটাউন হাওড়ার আমতায় তৈরি এই বুদ্ধমূর্তি। তার হাস্যময় মুখ ঠিক প্রথাগত স্মাইলিং বুদ্ধের মতো নয়। বরং এই মুখ যেন খুব চেনা, আদুরে। শুধুমাত্র বিদেশে রফতানির উদ্দেশে তৈরি এই মূর্তিগুলির একটি একরকম আবদার করেই কিনে এনেছিলেন রুদ্রনীল। একই রকম ভাবে তাঁর ঘরের বহু আসবাব ও অ্যান্টিক এ শহরের অলিগলি, হস্তশিল্প মেলা কিংবা বিদেশের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে কিনে আনা।
আলিপুর চিড়িয়াখানার কাছে এক সরু রাস্তার ভিতরের এক দোকান অভিনেতার সংগ্রহের প্রিয় ঠিকানা। এ ছাড়া রাসেল স্ট্রিটের অ্যান্টিকের দোকান তো রয়েছেই। প্রিয় শপিং ডেস্টিনেশন তাইল্যান্ড ও ইউএসএ। এই দু’টি জায়গা থেকে প্রচুর মেমেন্টো সংগ্রহ করে এনে বাড়ি সাজিয়েছেন অভিনেতা। কখনও কাস্টমসের ঝামেলায় পড়েছেন, কখনও লাগেজ ভারী হয়েছে— কিন্তু সংগ্রহ করার প্যাশনে ভাটা পড়েনি। যেমন তাইল্যান্ড থেকে কেনা কাঠের তৈরি বুদ্ধের বরাভয় হাতের মুদ্রা কিংবা বিংশ শতকের গোড়ার দিকের ডিজ়াইনের কাঠের টেলিফোন অথবা আমেরিকা থেকে কিনে আনা এক দেওয়ালগিরি। প্রিয় বরাভয় মুদ্রার নীচে দেওয়াল-লিখন— ‘এভরিথিং ইজ় পসিবল ইফ ইউ বিলিভ’। শিল্পমেলায় ঘুরে ঘুরেও সংগ্রহ করতে পছন্দ করেন অভিনেতা। বাটিকের উপরে কাজ করা পাঁচটি ঘোড়ার একটি ছবি এক শিল্পমেলার দোকানি তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন, শিল্পী হিসেবে তাঁকে কদর করেন বলে। সে উপহার সসম্মান ফ্রেম করে স্টাডির একপাশে রেখে দিয়েছেন রুদ্রনীল। নিজের কোনও আঁকা অবশ্য এখনও ফ্রেম করা হয়ে ওঠেনি তাঁর।
বাড়ির মধ্যে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় নিভৃত কোণটি হল ঘর-লাগোয়া বারান্দা। গ্লাস সিলিংয়ে ঢেকে নিয়েছেন খানিকটা, রোদ এলেও বৃষ্টির ঝাপটা যাতে ঘর পর্যন্ত না পৌঁছয়। বাহারি গাছে সাজানো সেই বারান্দায় রাখা একটি সাদা টিপয় ও দু’টি চেয়ার, যা তাঁর বন্ধুদেরও প্রিয় আড্ডাখানা। বন্ধুরা তাঁর সাজানো ফ্ল্যাট দেখে বলেছেন, ইন্টিরিয়র ডেকরেশনে তিনি ‘এ’ পেয়েছেন! আর তাঁর জন্মতারিখ ছয়। তাই ফ্ল্যাট নম্বর সিক্স এ-র বাসিন্দা রুদ্রনীল ঘোষ বাড়ির
কোনও নাম দেননি এখনও, নম্বরেই তিনি খুশি!