সন্তানধারণের অভিজ্ঞতা প্রত্যেক মেয়ের জীবনেই অনন্য। পরিবারে নতুন সদস্য আসার খবর জানার পরই হবু মায়ের শারীরিক এবং মানসিক জগতে এক বিপুল পরিবর্তন আসে। তবে এর সবটাই যে খুব আনন্দের, তা নয়। এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সহজ কথা নয়। খুব কম সময়ের মধ্যে একটা অন্য রূপে নিজেকে দেখার প্রস্তুতির মধ্যে এক প্রবল টানাপড়েন থাকে। আগামী দিনগুলো সম্পর্কে ভয়, উদ্বেগও থাকে। অনেকেই ভাবতে শুরু করে দেন— আমি কি ভাল মা হতে পারব? সন্তানের জন্ম থেকে তাকে মানুষ করা অবধি যে বিপুল খরচের ধাক্কা, তা-ই বা কী করে সামলানো যাবে? সন্তানকে সুস্থ রাখতে পারব তো? প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে যে নিয়মগুলি মেনে চলছি, সেগুলি গর্ভস্থ সন্তানের পক্ষে যথেষ্ট তো?
এই ভাবনার শেষ নেই। তাই গর্ভাবস্থায় মুড সুইংয়ের মতো উপসর্গগুলিও খুব অচেনা নয়। প্রয়োজন হল, এই মুড সুইংকে কী ভাবে ঠিকমতো সামলানো যায়, সেই পথটি খুঁজে বার করা।
কেন আসে অবসাদ?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, যে কোনও মানসিক অসুস্থতাই প্রেগন্যান্সির সময় বাড়তে পারে। এর ঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে অনুমান করা হয়, হরমোনাল ইমব্যালান্স থেকে হতে পারে, প্রেগন্যান্সি-জনিত চাপ থেকে হতে পারে, পারিপার্শ্বিক নানা বিষয়ের কারণেও হতে পারে। তবে আগে একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে, সন্তান আগমনের খবরে মানসিক অসুস্থতা কমে যায়— সেটা ঠিক নয়। বরং কিছু ক্ষেত্রে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অনেক সময় আগে কোনও মানসিক সমস্যা থাকলে এই পর্বে সেটা হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। আবার নতুন করে মানসিক সমস্যাও তৈরি হতে পারে। সুতরাং এই ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারণা থেকে সরে এসে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আগে থেকেই যাঁরা মানসিক সমস্যার জন্য ওষুধ খান, তাঁরা সেই ওষুধই খাবেন কি না, ডোজ় কী হবে, সেই সব নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। কিন্তু ইচ্ছেমতো ওষুধ বন্ধ করা চলবে না। কারণ, সেই ক্ষেত্রে সমস্যা আরও অনেক গুণ বেড়ে যেতে পারে।
কিন্তু এই মানসিক সমস্যা যে সবার ক্ষেত্রে হবে, তেমনটা নয়। অনেকের ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা হালকা মনখারাপ, কান্না পাওয়া, যখন-তখন রাগ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে ডা. মুখোপাধ্যায়ের মতে, এই লক্ষণগুলো প্রেগন্যান্সি পর্বের চেয়েও বাচ্চা হওয়ার পর আরও অনেক বেশি বাড়ে, যাকে বলে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা পোস্টপার্টাম ব্লুজ়। এর প্রধানতম কারণ বাচ্চা হওয়ার স্ট্রেস ঠিকমতো সামলাতে না পারা। বাচ্চাকে ঠিক রাখার সঙ্গে ওয়ার্কিং মাদারদের যোগ হয় ফের কাজের জগতে ফিরে যাওয়ার চাপ। ফলে সব মিলিয়ে অবসাদ বাড়তে থাকে।
করণীয় কী?
আসলে প্রেগন্যান্সি এবং বাচ্চা হওয়ার পরের পর্বের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মেয়েদের প্রায় একাই যুঝতে হয়। স্বামী, পরিবার তাকে বাইরে থেকে সাহায্য করতে পারে ঠিকই, কিন্তু সমস্যাগুলো ভাগ করে নিতে পারে না। ফলে উদ্বেগ, অবসাদ অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এটাকে অবহেলা করাও উচিত নয়। বাড়ির অন্যরা অনেক সময়েই একটা ভুল ধারণায় চালিত হন। তাঁরা ভাবেন, সন্তান হওয়াটাই তো যথেষ্ট আনন্দের। এর মধ্যে ডিপ্রেশন কেন আসবে? কিন্তু তেমনটা যে নয়, সেটা তাঁদেরও বুঝতে হবে। বাড়ির সবাই পাশে না থাকলে এ সময় ‘ভাল’ থাকাটা খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।
মুড সুইং হতে থাকলে কিছু সাধারণ বিষয় মেনে চলা যায়। যেমন— ঘুম যাতে পর্যাপ্ত হয়, সে দিকে নজর রাখা। অনেক সময় প্রেগন্যান্সির পরের পর্যায়ে ঘুম কমে আসে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে দেখতে হবে কোনও ওযুধের প্রয়োজন আছে কি না। এখন অনেকেই শেষ সপ্তাহ অবধি অফিসের কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে একটানা কাজ না করে, ছোট ছোট ভাগে কাজটাকে ভাগ করে মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এবং এর সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে শুধু বসে কাজ নয়, ফিজ়িক্যাল অ্যাক্টিভিটিও যাতে সমান তালে বজায় থাকে। অন্য কোনও শারীরিক সমস্যা না থাকলে হালকা কাজ করতে এ সময় কোনও বাধা থাকার কথা নয়। বরং তা বাচ্চার পক্ষে ভালই হবে। এর সঙ্গে পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া, লম্বা হাঁটা চালিয়ে যেতে হবে।
আর সব চিন্তাই শুধু বাচ্চার ভালমন্দের দিকে নয়। সেলফ-প্যাম্পারিংও এ সময়ে মুড ঠিক রাখতে দারুণ কাজে আসে।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
ঘরোয়া থেরাপিতে কাজ না দিলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে। ঘুম যদি একেবারেই চলে যায়, উদ্বেগ অতিরিক্ত বেড়ে যায়, খাওয়ার অভ্যেসে পরিবর্তন আসে, এবং যদি সাময়িক স্মৃতিভ্রম হয়, তবে দেরি না করে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে। কারণ, মানসিক সমস্যা থেকে শারীরিক নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। একটা কথা মনে রাখা উচিত, পরিবারে সন্তানের আগমন যতটা আনন্দের, তাকে ভাল রাখা পরিবারের যতটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, যিনি তার জন্ম দিলেন, তাকে ভাল রাখাও একই রকম দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তাই মায়েরও যত্ন নিতে হবে সমান ভাবে। মা ভাল থাকলে তবেই তো তাঁর সন্তানও ভাল থাকবে।