কয়েক বছর আগেও ‘ফ্যাটি লিভার ডিজিজ’(এফএলডি)– যে রোগের দরুন লিভারে অতিরিক্ত চর্বি তৈরি হয়, বেশিরভাগ চিকিৎসা সম্প্রদায়ের মধ্যে তা ‘সাধারণ রোগ’ হিসাবেই বিবেচিত হত। কলকাতার অ্যাপোলো গ্লেনেগেলস হাসপাতালের গ্যাস্ট্রো সায়েন্সেস এবং লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মহেশ গোয়েঙ্কার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে এই ধ্যানধারণায় একটা বড়সড় রদবদল ঘটেছে।
ডা. গোয়েঙ্কা বিশ্বাস করেন, চর্বিযুক্ত লিভারকে যদি অবহেলা করা হয়, চিকিৎসা না করানো হয়, তবে তা শরীরে ছোট-বড় নানারকম কু-প্রভাব ফেলতে থাকে। যা একসময় জনসংখ্যার নিরিখে যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করতে পারে।
‘এফএলডি’ ভারতের মতো দেশে গড়পড়তা সমস্যা, এবং বলা হয়, ‘এফএলডি’ ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ১০-২০ শতাংশ মানুষের মধ্যে বর্তমান। বা প্রতি পাঁচ থেকে দশজনের মধ্যে একজন।
‘ফ্যাটি লিভার ডিজিজ’-এর অর্থ হল লিভারে ফ্যাটগুলির স্বাভাবিক সংমিশ্রণ, যা প্রায় পরিমাণ প্রায় ৫ শতাংশ পর্যন্ত, তা কোনও কারণে বেড়েছে। ‘ফ্যাটি লিভার ডিজিজ’ মদ্যপানে, ভাইরাসের আক্রমণে, বিভিন্ন ওষুধের মাধ্যমে যেমন, ব্যথা কমানোর ওষুধ বা হৃদরোগের ওষুধের দ্বারাও হতে পারে।
“এই কারণগুলো ছাড়াও অন্য ধরনের ‘ফ্যাটি লিভার ডিজিজ’ও হতে পারে। তাকে নন-অ্যালকোহলযুক্ত ‘ফ্যাটি লিভার ডিজিজ’ বলা যেতে পারে। এই নন-অ্যালকোহলযুক্ত ‘ফ্যাটি লিভার ডিজিজ’ প্রায়শই ডায়াবেটিস, স্থূলত্ব, উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরলের অস্বাভাবিকতা ইত্যাদির মতো ব্যাধির সঙ্গে সম্পর্কিত। এবং তারা একসঙ্গে যা তৈরি করে তা পরিচিত ‘মেটাবলিক সিনড্রোম’ হিসাবে। সুতরাং, কারও যদি স্থূলত্ব ডায়াবেটিস, উচ্চ-রক্তচাপ বা রক্তে কোলেস্টেরল বেশি মাত্রায় থাকে, তবে তার ‘ফ্যাটি লিভার ডিজিজ’ রয়েছে কি না, তার পরীক্ষা করা উচিত।” ডা. গোয়েঙ্কা সাফ জানাচ্ছেন একথা।
অনেক ‘এফএলডি’ রোগীর অতিরিক্ত ওজন বা মোটা হওয়ার ধাত থাকে। এমনকী, উত্তরাধিকার সূত্রে, হরমোনজনিত, ওষুধের ফলে অথবা জৈবিক কারণেও রোগা ব্যক্তিদের মধ্যেও চর্বিযুক্ত লিভার খুঁজে পাওয়া যায়।
‘ফ্যাটি লিভার ডিজিজ প্রায়শই প্রতিভাত হয় না। বলা চলে, লক্ষ্মণহীন। যখন লিভার ফাংশন পরীক্ষায় অস্বাভাবিক ফলাফল পাওয়া যায় বা ফ্যাটি লিভার বলে আল্ট্রাসাউন্ডে সন্দেহ হয়, তখনই চিকিৎসার সুযোগ থাকে। তখন রোগীরাও কিছু কিছু লক্ষণের কথা জানাতে থাকেন, যা হয়তো খুবই সাধারণ লক্ষ্মণ– পেটে সামান্য অস্বস্তি, বা সন্ধের দিকে অল্প ক্লান্ত হয়ে পড়া।’ বলেছেন ডা. গোয়েঙ্কা।
তিনি আরও যোগ করেছেন যে, “চটজলদি এমআরআই (পিডিএফএফ) মাধ্যমে ‘এফএলডি’র শনাক্তকরণ সম্ভব, যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে লিভারের অবস্থান পরিষ্কারভাবে বুঝতে বায়োপসিরও প্রয়োজন হতে পারে।’ ফাইব্রোসিস বা সিরোসিসের উপস্থিতি ইলাস্ট্রোগ্রাফি বা ফাইব্রস্কানের মতো সহজ পরীক্ষার মাধ্যমেও জানা সম্ভব।
বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে, ‘এফএলডি’ প্রস্রাবের পরিমাণ হ্রাস, জন্ডিস এবং বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যা লিভার সিরোসিস হয়ে গোলমেলে সমস্যা তৈরি করতে পারে। যা কিনা লিভার ক্যানসারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
লিভারে চর্বি জমা হওয়া প্রতিরোধ করার জন্য কয়েকটি ওষুধ পাওয়া গেলেও, ‘এফএলডি’র বিরুদ্ধে চিকিৎসার সবচেয়ে কার্যকর পথ বলে দিচ্ছেন ডা. গোয়েঙ্কাই। বলেছেন, ‘জীবনযাত্রার পরিবর্তন এক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয়। ব্যায়াম করা এবং ওজন কমানোই অন্যতম সমাধান, তবে কিছু ক্ষেত্রে লিভার প্রতিস্থাপনের দরকার পরে।’
তাহলে ‘এফএলডি’ ধরা পড়লে রোগীদের কতটা উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত?
ডা. গোয়েঙ্কার মতে, ‘আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু একই সঙ্গে, রোগীদের গা-ছাড়া ভাবও কাম্য নয়, রোগ নির্ণয়ের পরে সচেতন থাকতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে, অসুখকে অবহেলা করা একেবারেই চলে না। কারণ এই রোগীদের একাংশ লিভার সিরোসিস বা ক্যানসারের মতো আরও গুরুতর ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে। তাই সচেতনতা কাম্য, আতঙ্ক অপ্রয়োজনীয়।’