বাড়ির পরিবেশ আগে সুস্থ করতে হবে। বাচ্চাটির কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। ফাইল ছবি।
আপাত দৃষ্টিতে বাচ্চাটি বেশ শান্ত। বাড়ির মধ্যে তেমন দুরন্তপনার নজিরও নেই। তা হলে সে স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের মারছে কেন? ছ’বছরের মেয়ের এই আচরণে সন্দিহান তার মা। স্কুলে গিয়ে বাচ্চাদের মারামারির ঘটনা সাধারণ সমস্যা। ছোট বয়সে এতে রাশ না টানলে, বড় হয়ে তা আরও জটিল হতে পারে।
স্কুলে চল্লিশ-পঞ্চাশ জন পড়ুয়া পিছু এক জন শিক্ষক। তাই ছোটখাটো মারামারির খবর অনেক সময়েই বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছয় না। ব্যাপারটি নিয়মিত হলে তবেই জানা যায়। তা ছাড়া পুল কার বা পেরেন্টদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকেও বাবা-মায়েরা জানতে পারেন। শুধু স্কুল নয়, তার বাইরেও বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলো করার সময়ে এটা হতে পারে। এই সমস্যা সদ্য স্কুলে যাওয়া শিশু থেকে টিনএজারের মধ্যেও দেখা যায়। এই ধরনের খবর কানে এলে ঠান্ডা মাথায় বিষয়টি সামলাতে হবে। প্রথমে বুঝতে হবে, বাচ্চাটি মারামারি করছে কেন?
সমস্যার উৎস কোথায়?
মনোবিদেরা একটা বিষয় স্পষ্ট করে দিচ্ছেন যে, বাড়িতে কোনও সমস্যা নেই তাও বাচ্চাটি অকারণে স্কুলে গিয়ে বা অন্য কোথাও বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি করছে, এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট দেবারতি আচার্য বলছিলেন, ‘‘শিশুটি হয়তো বাড়িতে অশান্তি দেখতে অভ্যস্ত। বাবা-মা ঝগড়া করছে, কেউ কারও গায়ে হাত তুলছে। এটা ওদের ইন্ধন জোগায়। তাই বন্ধুর সঙ্গে মতের অমিল হলেই সে গায়ে হাত তুলছে।’’ বাড়িতে বাচ্চার সঙ্গে বড়দের আচরণ কেমন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। পড়াশোনার জন্য বা অন্য কারণে তাকে মারধর করা হলে, সেও পাল্টা মারতে শিখবে। বাবা-মায়ের গায়ে হাত দিতে ভয় পাবে কিন্তু দুর্বল প্রতিপক্ষ খুঁজে বার করবে। ‘‘বাচ্চারা বড়দের কথার চেয়ে অ্যাকশন বেশি ফলো করে। আমরা হয়তো ওদের বোঝাচ্ছি, কাউকে মারবে না, ঝগড়া করবে না। কিন্তু শিশুটি দেখছে বাবা-মা যে কাজগুলো করতে তাকে বারণ করে, সেগুলো নিজেরাই করে। ফলে অভিভাবকের শত বোঝানোতেও কাজ হয় না,’’ মন্তব্য দেবারতির।
আরও কয়েকটি কারণে মারামারির প্রবণতা তৈরি হয়। ছোটদের মধ্যে এনার্জি প্রচুর। কিন্তু এখন তাদের খেলাধুলোর অবকাশ কম। এই এনার্জিটা অনেক সময়েই নেগেটিভ দিকে চালিত হয়। এ ছাড়া যে সব শিশুর আইকিউ লেভেল একটু কম, সামান্য অটিজ়ম আছে, তারা অনেক সময়ে রেগে যায়। অন্য বাচ্চার চেয়ে যে তারা পিছিয়ে, এটা মেনে নিতে ওদের সমস্যা হয়। সেই বিরক্তিটা আঘাতের মাধ্যমে প্রকাশ করে ফেলে।
শাস্তি নয়, প্রয়োজন সংশোধন
সন্তান যত বড় দোষই করুক না কেন, তাকে শাস্তি দেওয়ার বদলে সংশোধনের পরামর্শ দিচ্ছেন পেরেন্টিং কনসালটেন্ট পায়েল ঘোষ। ‘‘বাচ্চা কথা না শুনলে চটজলদি সমাধানের জন্য তাদের ফিজ়িক্যাল পানিশমেন্ট দেওয়া হয়। এই একই উপায় বাচ্চাটিও অবলম্বন করে। বাড়ির রাগ বন্ধুর উপর প্রকাশ করছে,’’ মন্তব্য পায়েলের।
তা বলে কি সন্তানকে শাসন করা যাবে না? নিশ্চয়ই যাবে কিন্তু তার পদ্ধতিটা অন্য রকম হবে। মনোবিদ দেবারতি আচার্যর কথায়, ‘‘শিশুকে কখনওই বলবেন না, ও খারাপ বা আপনি ওকে ভালবাসেন না। ওকে বলতে হবে, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি কিন্তু তুমি যে কাজটা করেছ সেটা আমার ভাল লাগেনি।’ শিশুরা আবেগপ্রবণ হয়। তাই আবেগ দিয়েই ওদের সঙ্গে কানেক্ট করা উচিত।’’ প্রয়োজনে ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিন। আপনি যে বিরক্ত হয়েছেন সেটা বোঝান। সপ্তাহের পিৎজ়া ট্রিটটা দেবেন না... এ ভাবে ছোট ছোট পদ্ধতির মাধ্যমে ওকে বোঝাতে হবে।
রাগ সামলানো জরুরি
রাগ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। ছোটদের রাগ বেশি হয়। ওরা চট করে রেগে যায় আবার তা দ্রুত কমেও যায়। তাই শিশুটি রেগে গিয়ে প্রতিক্রিয়া জানালে, ওকে পাল্টা মার দেওয়া উচিত নয়। রাগ নিয়ন্ত্রণের কয়েকটি পদ্ধতি বললেন পায়েল। ওদের হাতে একটা স্পঞ্জের বল দিন। বলুন খুব জোরে জোরে টিপতে। কাগজ-পেনসিল দিয়ে হিজিবিজি কাটতে বলুন। কিংবা একটা বালিশকে যত ইচ্ছে ঘুষি মারুক। এ ভাবে নেগেটিভ এনার্জি বেরিয়ে যাবে। জিজ্ঞেস করুন, এটা করে কি ওর একটু রাগ কমেছে? তার পর ওকে বোঝান। বড়রা অনেক সময়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। একটা শিশুর পক্ষে নিজে থেকে রাগ নিয়ন্ত্রণ করা আরও কঠিন। অ্যাঙ্গার ম্যানেজমেন্ট কাউন্সেলিং শিশুদের পাশাপাশি বাবা-মায়ের জন্যও প্রযোজ্য।
বাড়িতে সুস্থ পরিবেশ জরুরি
বাড়ির অশান্তি-ঝগড়ার প্রভাব শিশুর উপর পড়বেই। তাই বাড়ির পরিবেশ আগে সুস্থ করতে হবে। বাচ্চাটির কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। আপনি পাশে আছেন, এটা সন্তানকে বোঝানো খুব জরুরি। ছোট ছোট ঘটনা ওদের উপরে খুব প্রভাব ফেলে। ‘তুমি কিছু পারো না’ জাতীয় কথা শিশুকে বলবেন না। ধরা যাক, ক্লাস ওয়র্কের খাতায় কিছু জিনিস সে ঠিক করেছে, কিছু ভুল। শুরুতেই ভুলটা ধরবেন না। আগে ঠিকগুলোর জন্য প্রশংসা করুন। তার পর ভুলগুলো বুঝিয়ে দিন। এ ভাবেই ওরা মোটিভেটেড হবে। অনেক শিশু বাড়িতে যা চায়, তা পেয়ে যায়। এ বার বন্ধুর একটি জিনিস তার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু সেটা সে পাচ্ছে না। আক্রোশ থেকেই হয়তো বন্ধুকে সে আঘাত করল। বোঝাতে হবে, সব জিনিস চাইলেই পাওয়া যায় না।
বাড়ির সুস্থ পরিবেশ, পজ়িটিভ পেরেন্টিংয়ের পরেও যদি সন্তানের মধ্যে মারধর করার প্রবণতা দেখতে পান, তা হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কোন ছিদ্র দিয়ে ওর মধ্যে আক্রোশ আসছে, সেটা খুঁজে বার করতে হবে। হতে পারে কোনও কার্টুন চরিত্র বা ভায়োলেন্ট ভিডিয়ো তার মনে প্রভাব ফেলছে। কারণ না জানতে পারলে, সমাধানও অধরাই থাকবে।