নিউক্লিয়ার পরিবার। একমাত্র সন্তান। বাড়িতে সদস্য বলতে বাবা আর মা। আবদারের যত জিনিস, শিশুর একার জন্য। তার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মানসিকতা শিশুদের তৈরি হয় না। এই বোধ গড়ে তোলার জন্য পরিবার ও স্কুলের একটি বড় ভূমিকা থাকে। কিন্তু অতিমারি পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ মাসের পর মাস। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ বলতে ভার্চুয়াল মাধ্যম। যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিশুর এই সোশ্যাল স্কিল ডেভেলপ করা হচ্ছিল, এই দীর্ঘ বিরতি তাতে কি বিরূপ প্রভাব ফেলবে? পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষের মতে, ‘‘যখন স্কুল আবার খুলবে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তখন অনেক কিছুর সঙ্গেই শিশুকে মানিয়ে নিতে হবে। তাই এই দীর্ঘ ব্যবধানে ওর শেখা নষ্ট হবে না।’’ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘লকডাউনের শুরুর দিকে শিশুদের (বিশেষত প্রি-স্কুলের) সামলাতে অসুবিধে হচ্ছিল। কিন্তু এখন ওরা অনেকটা বুঝে গিয়েছে।’’ আবার মডার্ন হাই স্কুল ফর গার্লস-এর ডিরেক্টর দেবী করের মতে, ‘‘স্কুলের শিশুদের উপরে এর প্রভাব খুব বেশি। ওরা মুখিয়ে আছে স্কুলে আসার জন্য।’’
অভিভাবকদের দায়িত্ব
কয়েক প্রজন্ম আগেও বাড়িতে সদস্যসংখ্যা বেশি হলে বা ভাই-বোন থাকলে, শিশুদের আলাদা করে ভাগ করে নেওয়া শেখানোর দরকার হত না। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অভিভাবকের দায়িত্ব বেড়েছে বেশি। পায়েল ঘোষের মতে, পেরেন্টিংয়ের পাঠ শুরু করার আগে অভিভাবকদের তিনটি ধারণা মাথায় রাখতে হবে।
• ফুড শেয়ারিং: সাধারণত শিশুর পছন্দের চকলেট, ক্যান্ডি দিয়ে বাবা-মায়েরা এই পাঠ শুরু করেন। এতে অনেক শিশুরই আপত্তি থাকে। সেটা বাবা-মায়েরা বোঝেন না।
• জোর করে শেয়ার করানো: প্রি-স্কুল বা স্কুল থেকে যদি শিশুর শেয়ার করার সমস্যা নিয়ে অভিযোগ আসে, বাবা-মায়েরা তৎপর হয়ে ওঠেন। বাড়িতে অন্য শিশুদের ডেকে তাঁর সন্তানকে শেয়ারিং শেখাতে চেষ্টা করেন। তাঁদের বুঝতে হবে, শেয়ারিং কোনও টাস্ক নয়।
• দৃষ্টান্তের অভাব: মুখে না বলে বড়দেরও শেয়ার করতে হবে। তবেই সে দেখে শিখবে। ভাগ করে নেওয়ার শিক্ষা তিনটি ধাপে তৈরি করা যায়:
• অবজেক্ট শেয়ারিং: এমন খেলায় ব্যস্ত রাখুন, যেখানে একাধিক সদস্যের দরকার। এই পরিস্থিতিতে পাঁচটি শিশু যদি একসঙ্গে ক্রিকেট খেলে, তবে তারা স্বাস্থ্যবিধি পালনের মধ্য দিয়েই শেয়ারিং শিখতে পারে। কেউ স্যানিটাইজ়ারের বোতল নিয়ে গেলে বাকিদেরও সেখান থেকে ব্যবহার করতে দিতে হবে। এক বন্ধু হাইজিনের কথা ভুলে গেলে অন্য বন্ধু তাকে মনে করিয়ে দেবে।
• টাইম শেয়ারিং: পাঁচ জন শিশুকে গোল করে বসিয়ে গল্প বলার সুযোগ করে দিন। যে যার টার্ন অনুযায়ী গল্প বলবে। এ ক্ষেত্রে বসার সময়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাও দায়িত্ব, যা শিশুকে শেখাতে পারেন।
• নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগা: বাড়িতে অন্য শিশু এলে সন্তানের কাছে জেনে নিন, তার পছন্দের খেলনা কোনগুলি। সেগুলো বাদ দিয়ে অন্য খেলনা শেয়ার করতে বললে ওর নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হবে না। করোনার জন্য এখনও অবধি বন্ধুর বাড়ি গিয়ে খেলার অবকাশ হয়তো তৈরি হয়নি। তবে সুযোগ এলে, যে যার খেলনা ভাগ করে নেওয়াই ভাল। কারণ সেই স্বাস্থ্যবিধির পালন।
• পরিবারের সঙ্গ: শিশু না খেলেও ডিনার টেবলে ওর উপস্থিতি জরুরি। সকলকে একসঙ্গে খেতে দেখা, খাবার পরিবেশন, পরস্পরের সঙ্গে খাবার ভাগ করা... এ সব দেখে ওর মনে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করবে। তবে এখন বাড়ির বাইরে কারও সঙ্গে খাবার শেয়ার করতে হলে যে তাকে সতর্ক থাকতে হবে, তা-ও শিখিয়ে দিন।
সাবধানতা প্রয়োজন
• করোনা আবহে শিশুদের সাবধানতার পাঠ শেখানোও জরুরি
• প্রি-স্কুল ও স্কুলের শিশুদের ফুড শেয়ারিংয়ের বিষয়ে সতর্ক করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে তার নিজের খাবার অন্য কারও সঙ্গে শেয়ার না করাই ভাল
• টিনএজারদের বোঝাতে হবে, শুধু নিজেদের জন্য নয়, অন্যদের জন্যও স্বাস্থ্যবিধি মানা এক ধরনের শেয়ারিং
স্কুলের দায়িত্ব
পরিবারের পরেই আসে স্কুলের দায়িত্ব। তাঁর স্কুলের প্রাইমারি সেকশনের অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন দেবী কর, ‘‘দু’জন বন্ধুর মধ্যে যে বিষয়টিতে যে পিছিয়ে, অন্য জন তাকে সেটা শেখাবে। আমরা বলি, ‘পিয়ার মেন্টরস’। এমনও হয়েছে, টিফিন বিরতিতে এক ছাত্রী এসে শিক্ষিকাকে জানিয়েছে, যে তার পরীক্ষা বলে পিয়ার মেন্টর তাকে খেতে দিচ্ছে না। পড়া ঝালিয়ে নিতে বলছে।’’ ক্লাসের সঙ্গ না থাকায় অনলাইনে দুই বন্ধু পরস্পরকে সাহায্য করতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে অভিভাবকের মনিটরিংও প্রয়োজন।
অতিমারি পরিস্থিতিতে করণীয়
আবীর মুখোপাধ্যায়ের মতে, প্রি-স্কুল ও স্কুলের শিশুদের এখন একটি রুটিনের মধ্যে রাখা জরুরি। বাড়ির ছাদে বা সামনে উপযুক্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনেই ওদের খেলার সুযোগ করে দেওয়া যায়। ফোনে বন্ধুদের সঙ্গে সপ্তাহে এক বা দু’দিন করে কথা বলার ব্যবস্থা করা যায়। স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয় বলেই প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলা, বাড়ির কাছেই একটু হেঁটে আসা, সাইকেল রাইডিং... এই বিষয়গুলিতে আগ্রহ তৈরি করতে হবে। টিনএজাররা পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝে। কিন্তু হঠকারী হওয়ার প্রবণতা বাড়ে এই বয়সে। তাই বাবা-মায়েদের মনিটরিং জরুরি।
মনে রাখতে হবে, শিশুর কাছে শেয়ারিং যেন হয় আনন্দের পাঠ। টাস্ক হিসেবে শেখালে তারা কোনও দিনই শিখবে না।