—প্রতীকী চিত্র।
শৈশবে কোনও অঙ্গের গঠনে ত্রুটি থেকে গেলে, সারা জীবন তার জন্য ভুগতে হতে পারে। বিশেষ ভাবে খেয়াল করুন, বাচ্চার চোখে কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না। জন্মের পর দৃষ্টিশক্তি পুরোপুরি বিকশিত হতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। তার মধ্যে বাচ্চার চোখে নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনই একটি গুরুতর সমস্যা হল লেজ়ি আই। ঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু না করলে বাচ্চাটি পরবর্তী জীবনে অন্ধও হয়ে যেতে পারে। অথচ, সময়মতো চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। লেজ়ি আই অসুখটি কী, কী ভাবে তার নিরাময় সম্ভব, সেই বিষয়ে বিশদে জানালেন পেডিয়াট্রিক অপথ্যালমোলজিস্ট ও স্ট্র্যাবিসমোলজিস্ট ডা. দেবার্পিতা চৌধুরী।
লেজ়ি আই ঠিক কী
সাধারণত ছোট বাচ্চা বা স্কুলপড়ুয়া শিশুর লেজ়ি আই বা অ্যাম্বিলোপিয়ার সমস্যা হয়। এ ক্ষেত্রে শৈশবের একেবারে গোড়ার দিকে (আর্লি চাইল্ডহুড) বাচ্চার একটা কিংবা দুটো চোখেই দৃষ্টিশক্তির বিকাশ ঠিক ভাবে হয় না। যে চোখে সমস্যা সেই চোখে বাচ্চা ঝাপসা দেখবে। বিভিন্ন কারণে এই রোগ হয়। যেমন— রিফ্র্যাকটিভ এরর বা চোখে পাওয়ার হওয়ার ফলে। দ্বিতীয়ত, স্ট্র্যাবিসমিক বা স্কুইন্ট আইজ়-এর জন্য। অর্থাৎ বাচ্চার চোখের মণি দু’টির মধ্যে অসামঞ্জস্য থাকে। বাংলায় একেই ‘ট্যারা’ বলা হয়। তৃতীয়ত, ছোট বাচ্চার চোখে ছানি পড়লে বা তার কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হলে ডিপ্রাইভেশন হয়। অর্থাৎ বাচ্চার চোখে ঠিক ভাবে আলো পৌঁছয় না। তখনও সমস্যা হয়।
এ সব ক্ষেত্রে চোখ ভাল ভাবে কাজ করে না, তাই সমস্যাটিকে লেজ়ি আই বলা হয়। ডা. চৌধুরী বললেন, “মায়ের পেট থেকে বাচ্চা যদি ছানি নিয়ে জন্মায়, তা হলে তার জীবনের প্রথম দিন থেকেই সমস্যা থাকবে। প্রথম তিন বছরে বাচ্চার দৃষ্টিশক্তির বিকাশ খুব জরুরি। যা করতে হবে, ছয় মাস থেকে তিন বছর বয়সের মধ্যেই করতে হবে। এর মধ্যেই সমস্যাকে চিহ্নিত করে তার প্রতিকার করা দরকার।”
রোগ চেনার উপায়
এক বারও যদি অভিভাবকের সন্দেহ হয় যে, বাচ্চার দেখতে সমস্যা হচ্ছে, তখনই চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখিয়ে নিতে হবে।
প্রধান চিকিৎসা প্যাচিং
ডা. চৌধুরী বললেন, এত সতর্ক থাকার পরও অনেক সময়ে দেরি হয়ে যায়। বড়রা বুঝতে পারেন না যে বাচ্চাটা ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। তখন হয়তো চিকিৎসাতেও দেরি হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে ‘অ্যাগ্রেসিভ ট্রিটমেন্ট’ করে ত্রুটি মেরামত করতে হয়। চিকিৎসক আগে পরীক্ষা করে দেখেন লেজ়ি আই কোন কারণে হচ্ছে, কতটা ক্ষতি হয়েছে। তার পরে সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করেন। যেমন ‘রিফ্র্যাকটিভ এরর’ থাকলে পাওয়ার দেখে চশমা দেওয়া হয়। পাওয়ারের জন্য না অন্য কোনও কারণে চোখটা ট্যারা হয়েছে, সেটা দেখে স্কুইন্ট আইজ়ের চিকিৎসা হয়। প্রথমে চশমার সাহায্যে ট্যারা চোখ ঠিক করার চেষ্টা করা হয়, তাতে কাজ না হলে শল্যচিকিৎসা করে সমস্যার সমাধান করা হয়। তবে, লেজ়ি আই-এর প্রধান চিকিৎসা হল প্যাচিং। এতে দুটো চোখের যে চোখটা ভাল, সেটাকেই সব দিক দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। যাতে বাচ্চা কোনও ভাবেই সেই চোখ দিয়ে দেখতে না পারে। তার উপরে চশমা দেওয়া হয়। এর ফলে, বাচ্চা খারাপ চোখ বা ‘লেজ়ি আই’টি ব্যবহার করে দেখতে বাধ্য হয়। দিনের মধ্যে কিছুটা সময় ভাল চোখটা ঢেকে ওই লেজ়ি আই দিয়েই তাকে পড়াশোনা, গল্পের বই পড়া, টিভি দেখা ইত্যাদি সব কাজ করতে হবে। ওই চোখকে বারে বারে জোর করে ঠিক ভাবে কাজ করাতে বাধ্য করাতে হবে। এতে দুর্বল চোখটাও অন্য চোখের মতো স্বাভাবিক ক্রিয়াশীল হয়ে উঠবে।
ছানি বা কর্নিয়ার সমস্যার জন্য লেজ়ি আই দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব ছানি বা কর্নিয়ার অপারেশন করতে হয়। তার পর চশমা ও প্যাচিংয়ের সাহায্যে চিকিৎসা চলবে। যে বাচ্চা যত খারাপ দেখছে, তার উপর নির্ভর করবে কতটা সময় তাকে ‘প্যাচিং’ দেওয়া হবে। তবে, বাচ্চাকে চার ঘণ্টা, ছয় ঘণ্টা বা আট ঘণ্টা যত ক্ষণই প্যাচিং করাতে হোক, সেটা একটানা করানো সম্ভব নয়। অভিভাবককে ডায়েরিতে নোট লিখতে হবে— বিরতি দিয়ে দিয়ে সইয়ে সইয়ে প্যাচিং করিয়ে দিনের মোট প্যাচিং টাইমের লক্ষ্যপূরণ করা গেল কি না। স্কুলে গেলে প্যাচিং করানো সম্ভব হয় না। তখন সপ্তাহান্তের ছুটিতে প্যাচিংয়ের ঘাটতি পূরণ করতে হবে।
অ্যাম্বিলোপিয়ার চিকিৎসায় ডিজিটাল ভিশন থেরাপি বেশ কার্যকর। এই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি খানিকটা ভিডিয়ো গেমের মতো। এতেও খারাপ চোখের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা চলে। দেবার্পিতা জানালেন, যাঁরা চিকিৎসা করতে দেরি করে ফেলেছেন, এই চিকিৎসায় তাঁরাও ভাল ফল পেয়েছেন।
ঝুঁকি কখন বাড়ে
পারিবারিক ইতিহাসে দৃষ্টিশক্তির সমস্যা থাকলে, মা-বাবা দু’জনেরই চশমা থাকলে ছোট থেকেই বাচ্চার চোখের সমস্যা হতে পারে। মায়ের ছানি থাকলে বাচ্চারও ছানি পড়ার ঝুঁকি থাকে। তার থেকে লেজ়ি আই হয়ে যায়। আবার অনেক সময় দুটো চোখের গঠন সমান হয় না। একটা চোখ বড়, একটা চোখ ছোট থাকলেও চোখে পাওয়ারের সমস্যা থাকতে পারে। এগুলি সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। ডা. চৌধুরী বললেন, “অনেক সময়েই দেখা গিয়েছে, ছেলেমেয়েরা চোখের অসুবিধে নিয়েই দীর্ঘ দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। এ ভাবে যদি ১৮-১৯ বছর বয়স পর্যন্ত চোখকে অবহেলা করা হয়, তার পরে চিকিৎসকের কাছে গেলে তখন তাঁরাও প্রতিকার করতে সমস্যায় পড়েন। অন্তত ১২-১৩ বছর বয়সের মধ্যে চিকিৎসা করিয়ে নিতে হবে। তাতে যে ফলটা মিলবে, আরও দেরি করে চিকিৎসা করালে সেটা পাওয়া অসম্ভব না হলেও ভীষণ কঠিন। বছরের পর বছর চোখের অসুখ ফেলে রাখলে অন্ধত্বের ঝুঁকি বেড়ে যাবেই।” তবে, তাঁর আশ্বাস, সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে বাচ্চা দুই চোখেই আবার একই রকম দেখতে শুরু করবে।