গ্রাফিক— আনন্দবাজার অনলাইন
মেয়ের বিয়ের বয়স হলেই পাকিস্তানের বিরাদরিতে খোঁজ পড়ে ‘রিস্তা আন্টি’দের। তাঁদের কাজ, পরিবারের বিবাহযোগ্য কন্যাকে পোশাক-আশাক, রেহেন-সেহেনের তমিজ় শিখিয়ে, বিয়ের ‘উপযুক্ত’ সাজে সাজিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে পেশ করা। যাতে একনজরেই পাত্রী পছন্দ হয়। না হলে? দায়িত্ব সেখানেই শেষ হয় না। পাত্রের পরিবারের পছন্দ হওয়া নিয়ে যদি কোনও ধন্দ থাকে, তখন ‘সামান্য’ নজ়রানার বিনিময়ে পাত্রের সঙ্গেও পাত্রীর একান্ত সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন তাঁরা। বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর এই দেখা হওয়া ২০২৪ সালেও পাকিস্তানের বহু প্রদেশে একটু বাড়াবাড়ি হিসাবেই দেখা হয়। তবে প্রয়োজন হলে সেই সীমারেখা পার করাতেন ‘রিস্তা আন্টি’রাই। কারণ, পাকিস্তানে ডেটিং অ্যাপ এখনও ‘হারাম’, অর্থাৎ ইসলামে অনৈতিক। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে, নিজেদের ‘হলাল’ তকমা দিয়ে পাকিস্তানের বিয়ের বাজারে জাঁকিয়ে বসেছে এক ধরনের বিশেষ অ্যাপ।
‘হলাল’ শব্দটির অর্থ হল ‘ইসলামে অনুমোদিত’। পাকিস্তান এখনও ‘আগে প্রেম, পরে বিয়ে’ ভাবনায় খুব একটা বিশ্বাসী নয়। অধিকাংশ পাকিস্তানিরই বিয়ে হয় সম্বন্ধ করে। তার মধ্যে আবার ৩৮-৪৯ শতাংশের বিয়ে হয় তাঁদের সবচেয়ে কাছের তুতো ভাই বা বোনের সঙ্গে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা অন্তত তা-ই বলছে। তাতে বলা হচ্ছে, ওই সংস্কৃতি যে শুধু পাকিস্তানেই গণ্ডিবদ্ধ, তা নয়। ব্রিটেনে বসবাসকারী প্রবাসী পাকিস্তানিদের মধ্যেও ওই একই রীতির চল রয়েছে। সম্প্রতি পাকিস্তানে বিয়ে সংক্রান্ত আরও একটি পরিসংখ্যান জেনে অবাক হয়েছে দুনিয়া। ‘গ্যালাপ অ্যান্ড গিলানি পাকিস্তান’ নামে এক গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, ৮০ শতাংশ পাকিস্তানিই পরিবারের ঠিক করে দেওয়া পাত্র বা পাত্রীকে বিয়ে করেন। শুধু তা-ই নয়, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পাত্র-পাত্রীর প্রথম দেখা হচ্ছে বাগ্দানের দিনে। এ হেন দেশে যে ডেটিং অ্যাপ ‘অনৈতিক’ হবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তবে বিস্ময় জাগিয়েছে, স্বঘোষিত ‘হলাল’ অ্যাপগুলির গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা।
২৫ কোটি জনসংখ্যার পাকিস্তানে ইতিধ্যেই ১২ লক্ষ পরিবার ওই অ্যাপে নিজেদের কন্যা বা পুত্রের নাম নথিভুক্ত করিয়েছেন। অ্যাপ মারফত বিয়েও হয়েছে ১৫ হাজার পাক-দম্পতির। লাহোরের বাসিন্দা এজ়া নওয়াজ় সেই ১৫ হাজারের একজন। পেশায় টেক্সটাইল ডিজ়াইনার এজ়া অ্যাপের কথা জানতে পেরেছিলেন এক সহকর্মীর কাছ থেকে। তার আগে তাঁর বাবার ঠিক করে দেওয়া ‘রিস্তা আন্টি’র দৌলতে পাঁচ বছর ধরে চলছিল এজ়াকে পাত্রস্থ করার চেষ্টা। ২৫ বছরের তরুণী এক সময় বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন তাঁকে পাত্রস্থ করার জন্য বলা ‘রিস্তা আন্টি’দের মিথ্যাচারে। এজ়া বলেছেন, ‘‘আমি পাহাড়ে ট্রেকিং করতে ভালবাসি। কিন্তু ‘রিস্তা আন্টি’ বলে দিয়েছিলেন, পাত্রপক্ষ শখের কথা জানতে চাইলে সে সব বলা চলবে না। বলতে হবে রান্না করতে ভালবাসি। যেটা আমি পারিই না।’’ সহকর্মী অনলাইনে পাত্র দেখে বিয়ে করেছেন শুনেই এজ়া ঠিক করেছিলেন, এক বার অ্যাপেও চেষ্টা করে দেখবেন। এজ়া জানিয়েছেন, তাঁর স্বামীর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের তিন মাসের মধ্যেই তাঁদের বিয়ে হয়।
ঠিক কোন অঙ্কে নিজেদের ‘হলাল’ বলে দাবি করছে এবং রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন পাকিস্তানের পরিবারগুলির আস্থা অর্জন করতে পারছে ওই সমস্ত ম্যাট্রিমনি অ্যাপ? এজ়ার স্বামী ওয়াসিম আখতার জানাচ্ছেন, ওই অ্যাপে পাত্র বা পাত্রী চাইলে তাঁর ছবি ‘ব্লার’ বা ঝাপসা করে রাখতে পারেন। তিনিই ওই ছবি দেখতে পারবেন, যাঁকে সেটি দেখার অনুমতি দেওয়া হবে। কিছু কিছু অ্যাপ আবার পাত্র বা পাত্রীর সহচর বা সহচরীর কাজও করে। পাত্রপক্ষ বা পাত্রীপক্ষের কোনও একজন আত্মীয়কে বেছে নিয়ে তাঁর সঙ্গে হবু সম্পর্ক নিয়ে নিয়মিত কথাবার্তা বলা হয়। প্রতি সপ্তাহে ওই কথাবার্তার আদান প্রদানের স্ক্রিনশট্স বা ডকুমেন্ট পাঠানো হয় ইচ্ছুক পক্ষের কাছে। যাতে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারেন বাবা-মায়েরা।
যদিও পাকিস্তানের ‘রিস্তা আন্টি’রা অ্যাপ নিয়ে চিন্তিত নন। তাঁরা বলছেন, অ্যাপ বড়জোর দু’টি পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারে। কিন্তু মেয়েদের কী ভাবে পাত্রপক্ষের পছন্দসই হতে হয়, সেটা শেখাতে পারবে কি? ফউজিয়া আজ়ম দীর্ঘ দিন ধরে ঘটকালি করছেন পাকিস্তানে। তিনি বলছেন, ‘‘অ্যাপকে কখনওই পাকিস্তান পুরোপুরি মেনে নেবে না। সারা রাত ধরে পরপুরুষের সঙ্গে চ্যাট করা আমি তো পছন্দ করি না!’’ অ্যাপে ভরসা রাখতে পারছেন না পেশায় ডিজ়িটাল মিডিয়া শিল্পী অনীলাও (নাম পরিবর্তিত)। তাঁর বক্তব্য, ‘‘পুরুষেরা সাধারণত ওই সমস্ত অ্যাপে নিজের ব্যাপারে মিথ্যা কথাই বলে। তাই আমি অ্যাপে থাকলেও নিজের আসল নাম এবং পরিচয় দিইনি। আমার মনে হয়, পরিবারের বেছে দেওয়া সঙ্গীকে বিয়ে করা অনেক বেশি নিরাপদ।’’
তবে যে যা-ই বলুন, হলাল অ্যাপ যে পাকিস্তানকে কিছুটা হলেও বিয়ের ব্যাপারে আধুনিক করেছে, তা মানছেন ২৫ বছরের রিদা ফাতিমা। তিনি বলছেন, ‘‘আমি অবাক হয়ে দেখতাম ‘রিস্তা আন্টি’দের সাহস। ওরা আমার ব্যাপারে আমাকেই শেখাচ্ছে, আমার পরিবারকে শেখাচ্ছে, এমনকি, আমার কত জন ভাই থাকা উচিত বা উচিত নয়, ভবিষ্যতে আমি কী করব সেটাও ওরাই ঠিক করে দিচ্ছে! আর মেয়ে পাত্রস্থ হবে বলে পরিবার মুখ বুজে মেনেও নিত সেই সব অত্যাচার। সেই সবে লাগাম পরানো যাবে।’’ রিদাই বলছেন, ‘‘পাকিস্তানে পুরুষ যেমনই হোক, পাত্রীকে দেখতে হতে হবে মডেলের মতো। মাথায় চুল থাক বা না থাক, পেট মোটা হোক, হাতে সামান্য পয়সা থাকলেই তিনি দারুণ পাত্র। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হলে ‘রিস্তা আন্টি’রা মোটা টাকা নজ়রানা নেন। আর পাত্র যদি প্রবাসী হন, তবে তো কথাই নেই! ওই নজ়রানার পরিমাণ তখন আকাশ ছোঁয়। খুব সাধারণ প্রবাসী পাত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করানোর ‘রেট’ কম করে ৭০০ মার্কিন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৬০ হাজার টাকার কাছাকাছি)!’’ রিদার মতে ‘হলাল’ হোক বা না হোক, ‘রিস্তা আন্টি’দের একচ্ছত্র আধিপত্যে দাঁড়ি টেনে পাকিস্তানের সাধারণ পরিবারের সন্তানদের কাছে একটা নতুন দরজা খুলেছে এই অ্যাপ। যাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়।