সদ্যোজাত শিশুটির জন্মের খবরে পরিবারের মানুষ তখন সবে মিষ্টি বিতরণ শুরু করেছেন। এমন সময়েই চিন্তার মেঘ ঘনিয়ে আসে। জানা যায়, ক’দিনের একরত্তির জন্ডিস হয়েছে। এই ‘নিয়োনেটাল জন্ডিস’ বহু শিশুরই হয়, তারা সেরে উঠে বাড়িও চলে আসে। তবে ওইটুকু শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নরম, অপরিণত, সংবেদনশীল। তাই, নিয়োনেটাল জন্ডিস ঠিক সময়ে ধরা না পড়লে বা বাড়াবাড়ি হলে কিছু দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। অসুখটির কারণ, রোগলক্ষণ চেনার উপায়, চিকিৎসা ও সাবধানতা বিষয়ে বুঝিয়ে দিলেন শিশু চিকিৎসক ডা. অপূর্ব ঘোষ।
কেন হয় এই জন্ডিস
গর্ভে থাকাকালীন মায়ের ধমনী থেকে রক্ত পায় সন্তান। তাই শিশুর অক্সিজেন স্যাচুরেশন এ সময় কম থাকে। লোহিত রক্তকণিকা থাকে বেশি। কিন্তু জন্মের পর যখন নিজের ফুসফুস মারফত নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে, তখন স্বাভাবিক ভাবেই ওর অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ে। তখন আর অত লোহিত রক্তকণিকারও দরকার পড়ে না। ফলে ওই রক্তকণাগুলো ভেঙে যায়। সেই কণা ভেঙেই বিলিরুবিন তৈরি হয়। শিশুটির অপরিণত যকৃৎ ওই বিলিরুবিন বার করে দিতে পারে না। ফলে শরীরে বিলিরুবিন জমে জন্ডিস দেখা দেয়। এটি খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তবে প্রি-ম্যাচিয়োর শিশু যার যকৃৎ বেশ অপরিণত, তার ক্ষেত্রে বা যে শিশু স্তন্যপান করছে তার ক্ষেত্রেও জন্ডিসটা একটু বেড়ে যায়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে রক্তের সমস্যার জন্যও নিয়োনেটাল জন্ডিস হয়। মা আর সন্তানের রক্তের গ্রুপ আলাদা হলে এমন হতে পারে। মায়ের রক্ত যদি ‘ও’ গ্রুপের হয়, আর বাচ্চার রক্ত ‘এ’ বা ‘বি’ গ্রপের হয় কিংবা মায়ের যদি আরএইচ নেগেটিভ হয় আর বাচ্চার যদি আরএইচ পজ়িটিভ হয়, তখনও বাচ্চার জন্ডিস হয়।
মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অথবা জন্মের সময়ের কোনও সংক্রমণের জন্যও সদ্যোজাতের জন্ডিস হতে পারে। চিকিৎসকেরা এগুলিকে টর্চ ভাইরাস বলে চিহ্নিত করেন। রুবেলা, সাইটোমেগালো ভাইরাস, হারপিস সিম্পলেক্স, কনজেনিটাল সিফিলিস (এটি এখন কমে গিয়েছে) এই জন্ডিসের জন্য দায়ী।
প্যারোসিনিমিয়া, গ্যালাক্টোসিমিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস ইত্যাদি মেটাবলিজ়ম সংক্রান্ত জন্মগত ত্রুটির জন্যও জন্ডিস হয়।
কখন এটি বিপজ্জনক
দু’-তিনটি পরিস্থিতি নিয়ে চিকিৎসকেরা বেশি চিন্তায় থাকেন। যকৃৎ থেকে অন্ত্রে যাওয়ার পথটি যদি জন্ম থেকেই বন্ধ থাকে, তা হলেও সদ্যোজাতের জন্ডিস হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি এই রোগটি চিহ্নিত করে অস্ত্রোপচার করতে হয়।
আবার অনেক সময়ে জন্মগত ভাবে থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে জন্ডিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিছু শিশুর আবার মায়ের দুধ বা গরুর দুধ... কোনও দুধই সহ্য হয় না। সেটাও জন্ডিস হিসেবে দেখা দেয়। একে বলে গ্যালাক্টোসিমিয়া। তবে এটি খুবই বিরল ঘটনা। দেখা গিয়েছে ৪০,০০০-৬০,০০০-এ একটি বাচ্চার এই অসুখ হতে পারে। এই রোগ ধরতেও দেরি করা ঠিক নয়।
কতটা ভয়ের অসুখ?
নিয়োনেটাল জন্ডিসের ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা রোগীর মৃত্যু নিয়ে ভাবিত নন। তাঁদের চিন্তার কারণটা অন্য। জন্ডিস থাকে রক্তে। চিকিৎসকেরা লক্ষ রাখেন রোগটা যেন কোনও ভাবেই ‘ব্লাড-ব্রেন ব্যারিয়ার’ বা রক্ত আর মস্তিষ্কের মধ্যের বাধাটি না পেরোয়। অর্থাৎ রোগ যেন মাথায় উঠে না যায়। ব্রেনে জন্ডিস চলে গেলে মস্তিষ্কের কিছু ক্ষতি হতে পারে। ফলে কানে কম শোনা, ব্যালান্স হারিয়ে ফেলার মতো অসুবিধে দেখা দিতে পারে। ডা. ঘোষ বললেন, রোজ পরীক্ষা করলে অনেক সময়েই বাচ্চার মা-বাবা বিরক্ত হন। বলেন, এটুকু বাচ্চাকে খোঁচাখুঁচি করা কেন? আসলে চিকিৎসকদের জন্ডিস নিয়ে ভয় থাকে। আগেভাগেই জন্ডিস ধরে না ফেললে বাচ্চার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শিশুর জন্মের পর প্রথম সাত দিন এই ভয়টা বেশি। সাত দিন পরে ‘ব্লাড-ব্রেন ব্যারিয়ার’ পরিণত হয়ে যায়। বিপদ কমে।
চিকিৎসা ও সতর্কতা
নিয়োনেটাল জন্ডিস নিযন্ত্রণে চিকিৎসকেরা ফোটোথেরাপির সাহায্য নেন। রোগের প্রকৃতি অনুযায়ী মোটামুটি ৭২ ঘণ্টার পর শিশু সেরে উঠতে শুরু করে। রোগের বাড়াবাড়ি হলে রক্ত পাল্টানোর প্রয়োজন হয়। সাত দিন বয়সের পর বাচ্চার সহনশক্তি বাড়তে শুরু করলে আর নিয়োনেটাল জন্ডিস হয় না।
জন্মানোর পরে শিশুদের গায়ে লাল আভা থাকে। তাই জন্ডিস বুঝতে অসুবিধে হয়। তবে ওর চোখ দেখলে জন্ডিস চেনা যাবে। চামড়ায় বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দিলে যদি হলদেটে ভাব দেখা দেয়, সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
শিশুর জন্মের পর যদি হাসপাতাল থেকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়, তবে বাড়িতেও জন্ডিস হতে পারে। আমেরিকায় আজকাল আগেভাগেই ডিসচার্জ করা হচ্ছে বলে সেখানে জন্ডিসের ফলে শিশুর মস্তিষ্কের ক্ষতি হওয়ার সমস্যাও বাড়ছে। এ দেশে সাধারণত শিশুজন্মের পর হাসপাতাল থেকে খুব তাড়াতাড়ি ছুটি দেওয়া হয় না। প্রসঙ্গত, ওজন কম থাকলেও বাচ্চার জন্ডিস সহ্য করার ক্ষমতা কম হয়। ডা. ঘোষের পরামর্শ, ডিসচার্জের সময়ে বিলিরুবিন পরীক্ষা করাতে দ্বিধা করা ঠিক নয়। পরবর্তী কয়েক দিন চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা উচিত।