ত্বক ক্যানসার

তিল থেকে তাল হতেই পারে, চাই সতর্কতা

পায়ের পাতার নীচে একচিলতে কালো দাগ। অনেকটা বড়সড় তিলের মতো। গোড়ায় ব্যথা-জ্বালা ছিল না। কিছু দিন বাদে শুরু হল। পাড়ার ডাক্তারবাবুকে দেখাতে তিনি পায়ের কড়া কাটার মতো করে জায়গাটা কেটে দিলেন। ক’দিন সব ঠিকঠাক। ফের যে-কে-সে-ই! আবার ডাক্তার। আবার কাটা। তবে ডাক্তারবাবু না-চাইলেও রোগিণীর বাড়ির লোক এ বার কার্যত জবরদস্তি বায়পসি করালেন।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৫১
Share:

পায়ের পাতার নীচে একচিলতে কালো দাগ। অনেকটা বড়সড় তিলের মতো।

Advertisement

গোড়ায় ব্যথা-জ্বালা ছিল না। কিছু দিন বাদে শুরু হল। পাড়ার ডাক্তারবাবুকে দেখাতে তিনি পায়ের কড়া কাটার মতো করে জায়গাটা কেটে দিলেন। ক’দিন সব ঠিকঠাক। ফের যে-কে-সে-ই! আবার ডাক্তার। আবার কাটা। তবে ডাক্তারবাবু না-চাইলেও রোগিণীর বাড়ির লোক এ বার কার্যত জবরদস্তি বায়পসি করালেন।

আর তাতেই ধরা পড়ল, ব্যাপারটা মামুলি কিছু নয়। ক্যানসার! চামড়ার এক ধরনের কর্কট রোগ, যার পোশাকি নাম ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমা। ধাক্কার এখানেই শেষ নয়। অচিরে জানা গেল, রোগ শুধু পায়ের তলায় আটকে থাকেনি। উরুর উপর পর্যন্ত ডালপালা মেলেছে।

Advertisement

এ দেশে ত্বকের ক্যানসার প্রায় হয় না ভেবে যাঁরা নিশ্চিন্ত, তাঁরা নিঃসন্দেহে চমকে উঠবেন। উঠবে নানা প্রশ্নও। চিকিৎসকদের বড় অংশের কিন্তু দাবি: মেলানোমা রোগটা সাদা চামড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ— এমনটা আর বলা যাবে না। এখন ভারতেও ত্বকের ক্যানসার বিরল নয়। যার ব্যাখ্যা হিসেবে চর্মরোগ-চিকিৎসকদের অনেকের বক্তব্য, নির্বিচারে বৃক্ষছেদন ও ত্বকের উপরে নানাবিধ ‘সভ্যতার ‘অত্যাচারের’ শোধ তুলছে প্রকৃতি।

বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, দেহের অনাবৃত অংশেই সাধারণত মেলানোমা-র উৎপত্তি হয়। রোগটার ‘বায়োলজিকাল’ আচরণ আগাম আঁচ করা কঠিন। খুব অল্প সময়ে অন্য অঙ্গে ছড়ানোর আশঙ্কাও প্রবল। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ এর চিকিৎসা পদ্ধতি তথা সচেতনতা। কী রকম?

ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এই বিশেষ ধরনের ক্যানসারে কেমো বা রেডিয়েশন খুব কার্যকরী নয়। অস্ত্রোপচারই মূল চিকিৎসা। রোগ কত গভীরে পৌঁছেছে, তা যাচাই করে অপারেশন করা হয়।’’

এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের স্বার্থে সচেতনতার উপরে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন গৌতমবাবু। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমা হয় সাধারণত চল্লিশ বছর বয়সের পরে। তখন কারও দেহে পুরনো তিল আচমকা আকারে বাড়তে থাকলে কিংবা সেখান থেকে কোনও ক্ষরণ শুরু হলে অনেকে গুরুত্ব দেন না। কেউ কেউ আবার বিকল্প চিকিৎসা করান, যাতে রোগ ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। ‘‘একেবারে গোড়ায় ধরা পড়লে চিকিৎসার সুযোগ আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, অনেকেই দেরি করে ফেলছেন।’’— আক্ষেপ এক চর্মরোগ চিকিৎসকের।

এক সময়ে ভাবা হতো, চামড়ার ক্যানসার হয় শুধু অস্ট্রেলিয়ার মতো কিছু জায়গায়। সেখানে শরীরের কোথাও আচমকা তিল দেখলে বায়পসি করার চল রয়েছে। ভারতে এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামানোর ব্যাপার কোনও কালেই ছিল না। ছবিটা হঠাৎ বদলাচ্ছে কেন?

চর্মরোগ-চিকিৎসক সন্দীপন ধরের পর্যবেক্ষণ: পরিবেশে সবুজ দিন দিন কমছে। দ্রুত শিল্পায়ন হচ্ছে। উপরন্তু ওজোন স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি ত্বকে ঢুকছে বেশি হারে। এ সবেরই পরিণাম ত্বকের ক্যানসার। ‘‘দশ বছর আগে আমরা চোখ বুজে বলে দিতে পারতাম, এ দেশে ত্বকের ক্যানসার বিরল। এখন পারি না।’’— মন্তব্য সন্দীপনবাবুর। আগেই বা কেন ভাবা হতো যে, ভারতীয়েরা নিরাপদ?

চর্মরোগ-চিকিৎসক সঞ্জয় ঘোষের ব্যাখ্যা: আমেরিকা, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দাদের টাইপ ওয়ান ত্বক। মানে, খুব ফর্সা। ওই চামড়ায় মেলানিন কম থাকে।
ফলে অতি বেগুনি রশ্মি শরীরে সরাসরি প্রবেশ করে। অন্য দিকে ভারতীয়দের চামড়া টাইপ ফোর বা ফাইভ। এতে মেলানিনের সুরক্ষা-বর্ম থাকায় ঝুঁকি কম।

কিন্তু সেই পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছে। ‘‘শিল্পায়ন যত বেড়েছে, সবুজ ধ্বংস হয়েছে, ততই ওজোন লেয়ার ফুটো হয়ে চারপাশের পরিবেশকে বিপজ্জনক করে তুলেছে।’’— বলছেন সঞ্জয়বাবু। তিনি জানান, হাত-পায়ের তালুতে এক ধরনের মেলানোমা হয়, যা মূলত ভারতীয়দের মধ্যে বেশি। অনেকে অবহেলাও করেন। ফলে দ্রুত তা শরীরের অন্য অংশে ছড়িয়ে যায়।

এ ক্ষেত্রে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি বলে রায় দিয়েছেন সঞ্জয়বাবুও। বিপদ এড়াতে চিকিৎসকেরা কয়েকটা জিনিস এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে সন্দীপনবাবুর দাবি, তারুণ্য ধরে রাখতে গিয়ে মানুষ যে সব মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে, তার ফল মারাত্মক হতে পারে।’’ কী রকম?

সন্দীপনবাবু বলেন, ‘‘প্রথমে ধরা যাক, চুল রং করার হেয়ার ডাই। তাতে প্যারাফেনিলিন-ডাই-অ্যামাইন থাকে, যা থেকে অনেকের অ্যালার্জি হয়। এখন মনে করা হচ্ছে, কেমিক্যালটি হয়তো মেলানোমাও ডেকে আনতে পারে।’’ ইদানীং বিউটি পার্লারে গিয়ে চামড়ায় বিভিন্ন রাসায়নিক প্রয়োগের যে তুঙ্গ প্রবণতা, তার দিকেও আঙুল উঠছে। ‘‘তথাকথিত ভেষজ প্রসাধনীতে থাকে ফিউরোকোমারিন, যা কিনা সূর্যালোককে আকৃষ্ট করে। এটাও ক্ষতিকর।’’— জানাচ্ছেন সন্দীপনবাবু।

ঝুঁকি-তালিকায় আরও আছে। চামড়ায় অতিরিক্ত ব্লিচিং, ফর্সা হওয়ার ক্রিমের যথেচ্ছ ব্যবহারকেও সন্দেহের ফর্দে রাখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আক্রমণ কোন পথ ধরে আসছে, তা সুনিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না। সুতরাং সম্ভাব্য যাবতীয় সতর্কতা নিয়ে রাখাই শ্রেয়।

তবে চিকিৎসকেরা এ-ও জানিয়েছেন, ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমা’র ‘কেস’ সামনে আসছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। ক্যানসার-চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আগে ডায়গনিসিসের এত সুবিধে ছিল না। তাই বহু ক্ষেত্রে রোগ ধরাই পড়ত না। সাধারণ ঘা হিসেবে চিকিৎসা চলত। এখন আধুনিক নানা পদ্ধতিতে রোগ ধরা পড়ছে।’’ তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমনকী চিকিৎসকদের একাংশের মধ্যেও এই রোগ সম্পর্কে কাঙ্ক্ষিত সচেতনতা গড়ে ওঠেনি বলে আক্ষেপ শোনা গিয়েছে।

অন্য মতও অবশ্য রয়েছে। চিকিৎসকদের কারও কারও দাবি, মেলানোমা নিয়ে এখনই অত ভাবিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি আসেনি। যেমন চর্মরোগ-চিকিৎসক রথীন্দ্রনাথ দত্ত বলেন, ‘‘এ দেশে ত্বকের ক্যানসার এখনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটা মূলত সাদা চামড়ার মানুষদের অসুখ। ভারতীয় চামড়ায় মেলানিন রয়েছে, সেটাই সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করে।’’

তাই এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো অর্থহীন বলে তিনি মনে করছেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement