দাঁতের সমস্যায় রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্ট খুবই পরিচিত চিকিৎসা পদ্ধতি। লোকাল অ্যানাস্থেশিয়ার মাধ্যমে করা এই ট্রিটমেন্ট তুলনামূলক ভাবে যন্ত্রণাহীন। এই ট্রিটমেন্ট পৌঁছে যায় দাঁতের গোড়ার পাল্প পর্যন্ত। অনেক সময়ে দাঁত তুলে ফেলার চেয়ে তার গোড়ার সমস্যা সারিয়ে তা দীর্ঘস্থায়ী ভাবে রেখে দেওয়ার জন্যই বেছে নেওয়া হয় এই চিকিৎসা। বিশেষ করে ছোটদের ক্ষেত্রে বা সামনের দিকের দাঁতে সমস্যা তৈরি হলে সে ক্ষেত্রে দাঁত তুলে ফেলাটা শেষ অপশন। তার পরিবর্তে দেখা হয়, রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে দাঁতের শিকড় পর্যন্ত গিয়ে সমস্যাটি নির্মূল করা যায় কি না।
গোড়ার কথা
দাঁতের গোড়া নানা কারণে সংক্রমিত বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যেমন—
• অনেক দিন ধরে অযত্নে থাকায় দাঁতে বেড়ে যাওয়া ক্যাভিটির ফলে নার্ভ এক্সপোজ়ড হয়ে পড়া।
• দাঁতে তৈরি হওয়া কোনও ফাটল বা গর্ত বেড়ে যাওয়ার সমস্যা।
• কোনও চোট বা আঘাতে দাঁতের গোড়া নড়ে যাওয়া... ইত্যাদি।
দন্ত চিকিৎসক ডা. পারমিতা গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ক্যাভিটি যদি দাঁতের অনেক গভীর পর্যন্ত পৌঁছে যায়, যাকে আর ফিলিং করে সারিয়ে তোলা সম্ভব হয় না, তখনই রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্টের সাহায্য নিই আমরা। ছোটদের ক্ষেত্রে ক্রিকেট বল বা অন্য কোনও আঘাতে দাঁত নড়ে যায় অনেক সময়। এ সব ক্ষেত্রে দু’টি বিকল্পই থাকে। হয় দাঁতটা তুলে ফেলি, নয়তো রুট ক্যানাল করে দাঁতটি রেখে দিই।’’
রুট ক্যানাল কী?
দাঁতের একমাত্র জীবিত অংশ হল দাঁতের পাল্প। নার্ভ, কানেক্টিভ টিসু এবং রক্তনালি দিয়ে তৈরি হয় দাঁতের গোড়ার এই পাল্প। রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্টে এই ক্ষতিগ্রস্ত পাল্পটিই বার করে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়। এর পরে তার ভিতরে একটা ইনার ফিলিং মেটিরিয়াল দিয়ে দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে দাঁত একটি সম্পূর্ণ ডেড স্ট্রাকচারে পরিণত হয়ে গেলেও কাঠামো মজবুত থাকে। শেষে ক্রাউন বা ক্যাপ পরিয়ে দেওয়া হয়। মেটাল, ফাইবার... বিভিন্ন মেটিরিয়ালের তৈরি হতে পারে ক্যাপ। ক্যাপের দাম ও কোয়ালিটির উপরে ট্রিটমেন্টের সামগ্রিক খরচ নির্ভর করে।
সাধারণত একাধিক সিটিংয়ে রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্ট করা হয়। আবার যদি দেখা যায় সংক্রমণের মাত্রা তত বেশি নয়, ক্যানালগুলোর খুব বেশি ক্ষতি হয়নি, সে ক্ষেত্রে এক সিটিংয়েও এই চিকিৎসা করা হয়।
রুট ক্যানাল ফেলিয়োর
অনেক সময়ে রুট ক্যানাল ফেলিয়োর হয়। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হল, যদি ফিলিংটা ভাল করে না হয়ে থাকে, ডেড স্পেস রয়ে যায় কিংবা ভিতরে ইনফেকশনের রেশ থেকে যায়। সে ক্ষেত্রে ট্রিটমেন্টের পরেও সমস্যায় ফেলতে পারে সেই দাঁত। রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্ট করা দাঁত দিয়ে খুব শক্ত খাবার খেতে গিয়ে আঘাত লাগলে ফ্র্যাকচার হতে পারে। ডা. গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্টের ২৫ শতাংশ যদি ডেনটিস্টের কাজ হয়, বাকি ৭৫ শতাংশ মেনটেন করা কিন্তু রোগীর দায়িত্ব। চিকিৎসকেরা সাধারণত বছর পাঁচেকের গ্যারান্টি দিয়ে থাকলেও রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্টের সুফল কিন্তু ১০-১৫ বছর, এমনকি আজীবনও পাওয়া যেতে পারে।
দাঁতে খাবার আটকে গেলে, পাশের দাঁতে ক্যাভিটি হলে বা উপরের ক্রাউনটা কোনও ভাবে নষ্ট হয়ে গেলেও রুট ক্যানাল ট্রিটমেন্ট ফেলিয়োর হতে পারে। এই ট্রিটমেন্টের পরে তাই কয়েকটি সাধারণ নিয়ম মেনে চলা দরকার—
• দাঁতের ওই নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে খুব শক্ত কিছু খাওয়া এড়িয়ে চলুন, যাতে চাপ না পড়ে।
• নিয়মিত ব্রাশ এবং ফ্লস করা জরুরি। দুটো সাধারণ দাঁতের কনট্যাক্ট পয়েন্ট, আর রুট ক্যানাল করা দাঁতের সঙ্গে তার পাশেরটির কনট্যাক্ট পয়েন্টের মধ্যে পার্থক্য থাকে। কয়েক বছর পরে সেই কনট্যাক্ট পয়েন্টগুলো চওড়া হয়ে যেতে পারে। নিয়মিত ব্রাশ আর ফ্লস করার অভ্যেস থাকলে তখন তা কাজে দেয়।
• ডায়েটে বেশি করে ফাইবার রাখা উচিত। বেশি সুগার কনটেন্ট আছে এমন খাবার, অতিরিক্ত রিফাইনড কার্বোহাইড্রেট কম খেলেই ভাল। তা হলে চিকিৎসার ফল দীর্ঘস্থায়ী হয়।
• রুট ক্যানাল করা দাঁত নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি। একবার ট্রিটমেন্ট করিয়ে ভুলে গেলে চলবে না। মাসছয়েক অন্তর রিভিউ করানো দরকার।
দাঁত থাকতে দাঁতের যত্ন
দাঁতের যে কোনও রকমের ক্ষতি নিজে থেকে সারে না। শরীরের অন্যান্য অংশের ক্ষত নিরাময় নিজে থেকে হলেও দাঁতের ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। এটি ক্যালসিফায়েড স্ট্রাকচার হওয়ায় নিজে নিজে ঠিক হতে পারে না। হাড় ভেঙে গেলে তা নিজে থেকে বা সাপোর্টের মাধ্যমে জুড়ে যায়। কিন্তু দাঁতে কোনও গর্ত বা ফাটল হলে সেটা রয়েই যায় এবং বাড়তে থাকে। দাঁতের গোড়ায় হওয়া ক্ষতির পরিমাণ এবং পাশের দাঁতের অবস্থা বিবেচনা করে তবেই রুট ক্যানাল করা হয়ে থাকে। ট্রিটমেন্টের ফলে গোড়ার অংশ সিল করে দেওয়ার ফলে দাঁতের শিকড়ের আগায় থাকা ব্যাকটিরিয়া ভিতরে আসতে পারে না। ওরাল ক্যাভিটিও চট করে ক্ষতি করতে পারে না।
রুট ক্যানালের দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়ার জন্য যত্ন নিতে হবে নিয়মিত। বর্তমানে নিজের দাঁতের খেয়াল রাখলে পরে সেই দাঁতই খেয়াল রাখবে আপনার।