মডেল: রেজ়ওয়ান রব্বানি শেখ, অলিভিয়া সরকার; মেকআপ: প্রিয়া গুপ্ত ছবি: জয়দীপ মণ্ডল, অমিত দাস
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “একার ভিতরে একের দেখা না পাই,/ দুজনার যোগে পরম একের ঠাঁই।” (‘পরিণয়’)। বস্তুত এই ‘পরম একের’ সম্পৃক্তবোধটির সন্ধান করাটাই বোধহয় বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানটির প্রধান উদ্দেশ্য। ধুমধাম করে অনুষ্ঠান হোক বা সইসাবুদের মাধ্যমে বিয়ের ‘শুভখনের’ প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণার সঙ্গে শুরু হয় দু’টি ভিন্ন মানুষের পাশাপাশি পথ চলা। চলার পথে চড়াই-উতরাই, মনোমালিন্য, এ সবই স্বাভাবিক। বিবাহ বিচ্ছেদ, স্বাভাবিক তা-ও।
যদিও, আমাদের সমাজের সাধারণ ধারণা, ভারতবর্ষে বিচ্ছেদ, তা সে স্বল্প-দাম্পত্য জীবনেই হোক বা দীর্ঘ দিনের ‘গ্রে-হেয়ার’ দাম্পত্য, সংখ্যাটা বেশ কমই। কিন্তু, অসুখী দাম্পত্য, এই সংখ্যাটা কি কম?
বিষয়টি ভাবনার তো বটেই। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মীনাক্ষী খুরানা সাহার মতে, মূলত থিতু হতেই দু’জন মানুষ বিয়ে করেন। সঙ্গী পূর্ব-পরিচিত হোক বা না হোক, এই সময় পরস্পরকে নতুন করে চেনার তাগিদ থাকে। একসঙ্গে থাকার কারণে ধীরে ধীরে তার দোষ-গুণগুলি চোখে পড়ে। বিয়ের পরে মধুচন্দ্রিমা পর্ব কাটতেই শুরু হয় কঠিন বাস্তবের মখোমুখি হওয়ার পালা। মূলত, পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সম্মানের অভাব, একে অপরের প্রতি অকারণে সন্দেহভাজন হওয়া কিংবা সংসার ও তার চেয়েও বড় একে অপরের মনটির প্রতি যত্নবান না থাকা— এমন নানা কারণেই সম্পর্কে অশান্তি দেখা দিতে পারে। আর সে সূত্রেই শুভ পরিণয়ের পরিণতিতে খারাপ লাগা, দোষারোপ করার মতো বিষয়গুলি ক্রমাগত সামনে আসতে থাকে।
এখন প্রশ্ন হল, সুখী দাম্পত্যের চাবিকাঠি কোথায় লুকিয়ে। কোন কোন বিষয়গুলি খেয়াল রাখা যেতে পারে, তা জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা—
পারস্পরিক বোঝাপড়া
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম জানাচ্ছেন, কোনও সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল, প্রাথমিক স্তরেই নিজেদের মধ্যে কথা বলা, নিজেদের চেনার চেষ্টা করা। একই সঙ্গে জরুরি, একে অপরের ব্যক্তিসত্তাকে সম্মান জানানো। দু’জন পৃথক মানুষ যখন একসঙ্গে থাকা শুরু করেন, তখন পরস্পরের নিজস্ব পরিসরটি বোঝা প্রয়োজন। দৈনন্দিন নানা সূক্ষ্ম বিষয়, একে-অপরের বক্তব্যকে গুরুত্ব দেওয়া, এ সবের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সঙ্গীকে চেনার চাবিকাঠি। সঙ্গীর প্রতিদিনের চলাফেরা, কোনও অপরিচিতের সঙ্গে তার আচার-আচরণ বা কোনও কঠিন সময়ে নিজেকে সামলানোর পদ্ধতি— এই পর্যবেক্ষণগুলি সহজেই বুঝিয়ে দিতে পারে মানুষটি আসলে কেমন। দীর্ঘকাল এক সঙ্গে থাকতে গেলে দম্পতির মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে। এ ক্ষেত্রে ডাক্তার রামের মত, কোনও পক্ষ যদি সব সময় ভেবে বসেন ‘আমিই ঠিক’, তবে তা ভাঙনের দিকে বেশি করে এগিয়ে নিয়ে যায়।
আবার কোনও দম্পতি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে গেলে, অনেক সময়েই পরিবার বা বন্ধুমহল থেকে শুনতে হয়, ‘আহা, একটু মানিয়ে নিলেই হয়!’ কিন্তু মানিয়ে নেওয়াটা সব সমস্যার সমাধান নয়, বলছেন ম্যারিটাল কনসালট্যান্ট শতভিষা চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মতে, ‘মানিয়ে নেওয়া’ নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট জনের নিজস্ব চিন্তাধারার এবং পরস্পরকে বোঝা-না বোঝার উপরে।
মিলেমিশে করি কাজ
দাম্পত্যের পথ মসৃণ হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, দায়িত্ব নেওয়া এবং তা কতটা নিজেদের মধ্যে ভাগ করা যাচ্ছে, সেটা বুঝে নেওয়া। চাকরি কে করবে আর ঘরের কাজ কে করবে, এই চিন্তায় না গিয়ে ভাবা প্রয়োজন, দু’জনের মধ্যে কাজের ভাগাভাগিটা কী ভাবে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন সংসার খরচের ভাগাভাগিও। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে কর্মরত হলে এখনও বহু মহিলা সংসার খরচে প্রয়োজন মতো নিয়মিত আর্থিক দায়িত্ব ভাগ করে নিতে চান না। এ ক্ষেত্রে স্ত্রীদের অনেক সময় যুক্তি, ‘স্বামীর নিজের বাবা-মা-বোন রয়েছে, তাই খরচা বেশি করে। আমার মা-বাবার দেখাশোনার খরচ তো আমাকেও দিতে হয়, সেটা কোথা থেকে আসবে!’ তেমনই বহু স্বামীও আছেন, রোজগার করেন না বলে স্ত্রীর বাবা-মায়ের পাশে দাঁড়াতে অনীহা। এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের মত, এ ভাবে ‘আমি তুমি’তে বিভেদ সৃষ্টি না করে দু’পক্ষেরই উচিত পরস্পরের পাশে দাঁড়ানো এবং বিয়ের আগে এ বিষয়ে কথা বলে নেওয়া। সংসার খরচ, বাড়ির ইএমআই বা অবসর-পরিকল্পনা, সব কিছু নিয়েই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা থাকা দরকার। তা হলে সংসারে থাকবে স্বচ্ছতা। অর্থকরী দিকটি বহু ক্ষেত্রে তিক্ততার জন্ম দেয়।
যত্ন জরুরি
যদি মনে হয়, কিছু ন্যূনতম চাওয়া-পাওয়ার বিষয়েও সঙ্গী যত্নবান নন, তবে দাম্পত্যের ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে যায়। চিকিৎসক রামের কথায়, সম্পর্ক হয় সমানে-সমানে। এটাও মাথায় রাখা দরকার, একজন অপরের জন্য অনেক কিছু করছে, আর অন্য জন সেটিকে ‘স্বাভাবিক’ বলে ধরে নিয়ে কিছুই করছে না, এমনটা যাতে না হয়। সম্পর্ককে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে তাতে নিয়ম করে জল দিতেই হবে। পরস্পরকে সময় দেওয়াটা এ ক্ষেত্রে ভীষণ জরুরি। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে সাংসারিক চাপে নিজেদের জন্য সময় বাঁচে কোথায়? কিন্তু তখনও একদিন বিকেলে একসঙ্গে দু’জনে বেরিয়ে পড়ুন। হোক না সেটা মিনিট পনেরোর জন্য। একটু দূরে গিয়ে ফুচকা খেয়ে এলেন। দেখবেন, কত কথা বেরিয়ে আসছে। মনটাও দিব্যি ফুরফুরে লাগছে।
পাশাপাশি, অনেক সময়েই দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রী নিজেরা সমস্যা মেটাতে পারছে না। সে ক্ষেত্রে, দাম্পত্যের যে কোনও পর্বে, উপযুক্ত পরামর্শদাতার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এই পরামর্শদাতা শ্বশুর-শাশুড়ি, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় বা ম্যারিটাল কাউন্সিলরও হতে পারেন। বস্তুত অনেক ক্ষেত্রেই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের হস্তক্ষেপে জটিল পরিস্থিতির সমাধান হয়। কিন্তু উল্টোটাও ঘটে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতামত, একান্ত ব্যক্তিগত পরিসরে ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আদৌ তাঁদের মতামত কতটা প্রয়োজন, সে বিষয়ে নিজস্ব বিবেচনাবোধটি খুবই জরুরি। পাশাপাশি, নিজস্ব গণ্ডি সম্পর্কে সচেতন থাকা দরকার আত্মীয়দেরও।
সেই সঙ্গে এ-ও সত্যি, সমস্যার সমাধান না হয়ে যখন বিচ্ছেদের পথ বেছে নেয় কোনও দম্পতি, তখন বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন অনেকেই। কিন্তু এই অবস্থায় বুঝতে হবে, ভবিষ্যতে একজন কী ভাবে বাঁচতে চাইছেন। অসুখী হয়ে পরিবার বা সমাজের চাপে জোর করে একসঙ্গে থাকাটা মনের উপরে চাপ তৈরি করে। এ ক্ষেত্রে বাস্তবকে মেনে নেওয়াই শ্রেয়।