শহর জুড়ে রোজ বেড়ে চলেছে বায়ুদূষণ।
বছর দশেকের সায়ন মাঝেমধ্যেই শ্বাসকষ্টে ভোগে। সর্দি-কাশির সমস্যা তো লেগেই রয়েছে সারা বছর ধরে। চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরে জানা যায়, অধিকাংশ রাতেই সায়নের শোয়ার ঘরে মশার ধূপ জ্বালানো হয় সারা রাত। আর সেই ধূপের ধোঁয়া থেকেই শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা তৈরি হয়েছে তার।
একই ভাবে বছর বারোর প্রিয়াঙ্কাও শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছে বেশ কিছু দিন ধরে। তাদের দু’কামরার ফ্ল্যাটে একটি ঘরে ধূপকাঠি জ্বলে দিনের বেশির ভাগ সময়েই। সেই ধূপের ধোঁয়া থেকে তার শ্বাসকষ্টের সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
শহর জুড়ে রোজ বেড়ে চলেছে বায়ুদূষণ। কখনও আবার এ শহরের দূষণ ছাপিয়ে যাচ্ছে দিল্লির আকাশকেও। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, সায়ন, প্রিয়াঙ্কার মতো কিশোর-কিশোরীরাও এর জেরে ভুগছে। আগামী কাল, পয়লা মে ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাস্থমা ডে’। সেই উপলক্ষে সাধারণ মানুষকে দূষণ ও তার জেরে শ্বাসকষ্টের নানা রকম সমস্যা নিয়ে সচেতন করতে উদ্যোগী হয়েছেন এ শহরের চিকিৎসক এবং একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
শুধু বাইরের দূষণই নয়, ‘ঘরের দূষণের’ জেরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কমবয়সিদের নানা শ্বাসকষ্টজনিত ও বক্ষরোগ সংক্রান্ত সমস্যা হচ্ছে। বিশেষত, কলকাতার মতো শহরে এমন অনেক রোগীই দেখা যাচ্ছে, যাদের শ্বাসকষ্টের মূল কারণ ‘ঘরের দূষণ’। তাই সেই সম্পর্কে সতর্ক হওয়া জরুরি বলেই মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
বক্ষরোগ চিকিৎসকদের একাংশ জানাচ্ছেন, গ্রীষ্মে এ শহরে বক্ষরোগ সংক্রান্ত সমস্যা বাড়ে। ধুলো-বালির জেরে বাইরে বেশিক্ষণ থাকা কষ্টকর হয়। তবে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বয়স্কদের সমস্যা হিসেবেই দেখা হত। এখন সে ছবি বদলে যাচ্ছে। শিশুদের মধ্যেও এখন এ ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রতি দশ জন ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) আক্রান্তের মধ্যে চার জন আট থেকে পনেরো বছরের মধ্যে। চিকিৎসকেরা জানালেন, এ শহরে ৩৫-৪৫ বছর বয়সিদের ফুসফুস সব চেয়ে সুস্থ। তবে অসতর্কতা ও অসচেতনতার জেরেই শিশুদের মধ্যে সমস্যা বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা।
পালমনোলজির চিকিৎসক রাজা ধরের কথায়, ‘‘বাইরের দূষণ কমানোর প্রক্রিয়া দীর্ঘ। কিন্তু একটু সতর্ক হলেই ঘরের ভিতরের দূষণ কমানো যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘরের ভিতরের দূষণের জেরে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা তৈরি হচ্ছে।’’ তিনি জানাচ্ছেন, ধূপকাঠি, মশা মারার তেল কিংবা যে কোনও জ্বালানির ধোঁয়ার জেরেও দূষণ ছড়ায়। বিশেষত, বন্ধ ঘরে কোনও ধরনের ধোঁয়া শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু বাইরের দূষণ নিয়ে যে সামান্য সতর্কতা তৈরি হলেও ঘরের দূষণ নিয়ে তেমন সচেতনতা ছড়ায়নি।
শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ অবশ্য জানাচ্ছেন, শিশুদের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টকে দ্রুত সিওপিডি-র তকমা দেওয়া কঠিন। তবে শিশুদের মধ্যে হাঁপানির মতো সমস্যা বেশি দেখা দিচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘শহরের বহু শিশু হাঁপানির মতো সমস্যায় ভুগছে। ছোট্ট ঘরের এক পাশে ধোঁয়া উঠছে রান্নার জ্বালানি থেকে, আর এক পাশে বাচ্চা পড়াশোনা করছে। এই বদ্ধ শহুরে পরিবেশ ফুসফুসের রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।’’
‘ন্যাশনাল অ্যালার্জি, অ্যাস্থমা, ব্রঙ্কাইটিস ইনস্টিটিউট’-এর কর্তা চিকিৎসক অলকগোপাল ঘোষালের পরামর্শ, খোলা পরিবেশই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে। এসি চালিয়ে জানলা-দরজা বন্ধ করে থাকলে দূষণের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না। বরং নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা তৈরি হবে। ছোট থেকেই প্রাকৃতিক আলো-বাতাসে অভ্যস্থ হলে অনেক সমস্যা কমে যাবে। পাশাপাশি তিনি জানান, শিশুদের ফুসফুসের সমস্যা কমাতে হলে মশা মারার ধূপ ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা জরুরি। ঘুমোনোর সময়ে মশারি টাঙানো অভ্যাস করতে হবে। তাঁর কথায়, ‘‘কৃত্রিম জীবনযাপন নয়, স্বাভাবিক ভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠলে শিশুরা অনেক রোগ থেকেই মুক্ত থাকবে।’’