খুদের শব্দ চয়নে বিড়়ম্বনায় অভিভাবকেরা। কী ভাবে তাদের বোঝাবেন? ছবি: শাটারস্টক
লোকসমাজে যে শব্দবন্ধ বা ভাষা ব্যবহার করা চলে না, সেই ভাষাই অনায়াসে বলে ফেলছে কমবয়সি ছেলেমেয়েরা। কখনও বুঝে, কখনও আবার না বুঝে। তা নিয়েই বিড়ম্বনায় পড়েন অভিভাবকেরা।
যেমন, পারিবারিক আাড্ডায়, তুতো ভাইদের সঙ্গে ভিডিয়ো গেম খেলতে খেলতে হঠাৎ উত্তেজিত সায়কের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল এমন শব্দ, যা বড়দের সামনে কেউ ব্যবহারই করে না। একঘর লোকের সামনে লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার জোগাড় সায়কের বাবা-মায়ের।
অনেক সময় না-বুঝেই অনুকরণ করে ছোটরা। সমস্যা হয় তা নিয়েও। বাঙালি হলেও ভিন্রাজ্যে স্বামী-সন্তানের সঙ্গে থাকতেন সুতপা। হঠাৎ এক দিন আধো- আধো কথা বলা মেয়ের মুখে অন্য ভাষায় অশ্লীল শব্দ শুনে চমকে গিয়েছিলেন তিনি। এক ধমকে চুপ করিয়েছিলেন।
ঘটনা আলাদা হলেও অনেক অভিভাবকই হয়তো এমন পরিস্থিতির সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন। কখনও ছোটরা, কখনও আবার বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা এমন শব্দবন্ধ ব্যবহার করছে, যা সমাজের কাছে অশালীন বলেই বিবেচিত। বয়সে অনেকটা ছোট হলে বাবা-মায়েরা কখনও তাদের ধমকে থামিয়ে দিচ্ছেন বটে, কিন্তু কৈশোরে পা দেওয়া সন্তানকে কি এ ভাবে আটকানো যায়? পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট বলছেন, ‘‘ধমক দেওয়া, গায়ে হাত তোলা এই সমস্যার সমাধান নয়। বিশেষত বয়ঃসন্ধির সন্তানদের বকাঝকা করলে বিষয়টি হিতে বিপরীত হতে পারে।’’ মনো-সমাজকর্মী মোহিত রণদীপের কথায়, এই বয়সটায় তাদের শব্দের পরিধি বাড়ে। নানা ভাবে অনেক নতুন শব্দ তারা শেখে। কোনওটা হয়তো না বুঝেই ব্যবহার করে ফেলে তারা। তবে সকলেই যে তা করে, এমন নয়।
মুঠোফোনের দৌলতে বিনোদনের জগৎ এখন অনেকটাই প্রসারিত। এক ক্লিকেই ইচ্ছামতো সিনেমা, সিরিজ় দেখে ফেলা যায়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, বড়দের কথোপকথন, এমনকি সিনেমার সংলাপ থেকেও নানা ভাষা, কথা বলার ভঙ্গিমা খুব সহজে আয়ত্তে করে ফেলতে পারে ছোটরা। কিশোর-কিশোরীদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একই। কখনও হয়তো একটি শব্দ কারও সামনে বলা যায় না জেনেও, অন্যকে প্রয়োগ করতে দেখে সে-ও বলে ফেলে। সেই কথার ধার, ভার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাই তার থাকে না। মোহিত বলছেন, ‘‘অনেক সময়ে ছোটরা এমন শব্দ বলে ফেলছে, যা গালিগালাজ হিসাবে ধরা হয়। সেটা হয়তো একেবারে না বুঝেই। কাউকে বলতে শুনেছে বলে। তবে কৈশোরে বা যৌবনে বন্ধুমহলে এমন অনেক শব্দের প্রয়োগই হয়, সেটা নতুন নয়। কিন্তু কোন কথা কোথায় বলা চলে, সেই ধারণার অভাব সমস্যা তৈরি করছে।’’
কী ভাবে সন্তানদের দিশা দেখাবেন অভিভাবকেরা?
ভাল ভাবে তাদের বোঝাতে হবে। মেরে-বকে নয়। ছোটরা অনেক সময় বড়দের মুখেই এই ধরনের শব্দ শুনে শিখে ফেলে। তার প্রয়োগ না জানায় যে কোনও সময়ে বলে ফেলে। পায়েল বলছেন, ‘‘রাগের সময় বড়রাই কিন্তু এমন অনেক ভাষা বা শব্দ অন্য মানুষটিকে বলে ফেলেন, যা পরিশীলিত নয়। সেই শব্দ সন্তানের কানে গেলে সেও কিন্তু এমন ভাবেই কথা বলতে শিখবে। প্রথমেই তাই বড়দের নিজের আচরণ, শব্দচয়নের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।’’
বড়দের বা বাইরের লোকজনের সামনে ছেলে-মেয়ে আপত্তিকর শব্দ প্রয়োগ করে ফেললে তৎক্ষণাৎ তাকে বকাবকি না করে বরং পরে শান্ত ভাবে কথা বলার পরামর্শ দিচ্ছেন মনো-সমাজকর্মী। মোহিতের বক্তব্য, তাকে বোঝানো দরকার, সব কথা সব মহলে বলা চলে না। কোন কথার কী অর্থ হতে পারে, খারাপ-ভালটা তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে।
শুধু মুখের ভাষা নয়, অনেক সময় নানা ধরনের শরীরী ভাষাও ছোটরা আয়ত্ত করে ফেলে। যেমন, মধ্যমার আঙুল দেখানো। এর অর্থ সম্পর্কে হয়তো ধারণা নেই, কাউকে এমনটা করতে দেখেছে। সে ক্ষেত্রে অভিভাবককে তার মতো করে বিষয়টা বোঝাতে হবে।
পায়েলের পরামর্শ, বাড়িতে একটা নিয়ম করে দেওয়া যেতে পারে। কোন শব্দ বাড়িতে বা বড়দের বলা চলে না। যে কোনও পোশাক পরে যেমন যে কোনও জায়গায় যাওয়া যায় না, যে কোনও শব্দ সকলের সামনে বলতে নেই, এই বোধটা তাদের মধ্যে প্রবেশ করাতে হবে। তার পরেও এক ঘটনা ঘটলে চোখের ইঙ্গিতে বা নীরব আচরণে অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারেন বাবা-মায়েরা।
বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের কাছে এই ধরনের শব্দপ্রয়োগ অনেক সময়ে তাদের ভাষায় ‘কুল’ বলে মনে হয়। অর্থাৎ, ঠিক আছে। এ ক্ষেত্রে একটি শব্দ প্রয়োগে তার প্রভাব কী হতে পারে, কারও সঙ্গে সম্পর্ক, ভাবমূর্তিও যে নষ্ট হতে পারে, তা যদি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো সম্ভব হয়, বিষয়টি কার্যকর হতে পারে।