একাদশ শ্রেণিতে প্রথম দিন। নতুন স্কুলে বিদিশার একমাত্র বন্ধু তনুজা। একই টিউটোরিয়ালে ওরা পড়ত। স্কুলে তনুজাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে জনা তিনেক ছেলে। চার জনে দিব্যি গল্প করছে। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে বিদিশা ভাবছে, তনুজাকে এখন ডাকা ঠিক হবে? তা হলে ছেলেগুলোর চোখ তার দিকেও যে ঘুরবে! এই ভাবনা খুব একটা স্বস্তি দেয় না বিদিশাকে...
উল্লিখিত ঘটনাটি আপনার চেনা বৃত্তের অনেকের সঙ্গেই হতে পারে। বয়ঃসন্ধিতে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ স্বাভাবিক। দীর্ঘ সময় ধরে বয়েজ় বা গালর্স স্কুলে পড়ার পরে, প্রথম বার কো-এড আবহে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হতে পারে। বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে সহজ হতে না পারা অনেক ক্ষেত্রে বন্ধুত্বেও তৈরি করে জটিলতা। সকলের যে এই অসুবিধে হবে, তা নয়। তবে অভিভাবকের খানিক সহযোগিতা পেলে সাময়িক বাধাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে টিনএজাররা।
বহিরঙ্গে সমস্যা...
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবীর মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘বয়েজ় বা গার্লস স্কুল একটা ভ্যারিয়েবল মাত্র। আরও কয়েকটি ফ্যাক্টর কাজ করে। ছোট বয়স থেকে কো-এড স্কুলে পড়লেই যে বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে কথা বলায় জড়তা থাকবে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।’’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়রঞ্জন রাম এই সমস্যার তিনটি দিকের উপরে আলোকপাত করলেন— ‘‘প্রথমত, বয়েজ় বা গার্লস স্কুলে পড়লেও যদি পরিবার, পাড়া বা বন্ধুমহলে ছোট বয়স থেকে বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ থাকে, তবে সমস্যাটা প্রভাব ফেলে না। দ্বিতীয়ত, একটি ছেলে বা মেয়ের পরিবার কতটা রক্ষণশীল, তার উপরে এই মেলামেশার জায়গাটা নির্ভর করে।’’ এ ক্ষেত্রে একমত আবীর মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়, ‘‘রক্ষণশীল পরিবারে যদি কোনও মেয়েকে ছেলেদের সঙ্গে মিশতে বারণ করা হয়, করলে শাস্তি দেওয়া হয় বা বিপরীত লিঙ্গ সম্পর্কে একপেশে কতকগুলি ধারণা শেখানো হয়, তবে তাদের এমন সম্পর্ক তৈরি করতে অসুবিধে হতে পারে।’’
জয়রঞ্জন রামের মতে, তৃতীয় ফ্যাক্টরটি হল পরিবারে কারও সম্পর্কে (বিপরীত লিঙ্গের সঙ্গে) বিরূপ অভিজ্ঞতা চাক্ষুষ করা। সেখান থেকে বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় অসুবিধে তৈরি হতে পারে টিনএজারদের।
পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরিখে বললেন, ‘‘গার্লস স্কুল থেকে কো-এড স্কুলে পড়তে আসা মেয়েরা এই বয়সে খুব পজ়েসিভ হয়ে পড়ে। সে হয়তো কোনও ছেলের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছে। সেই ছেলের সঙ্গে বাকি মেয়েদের বন্ধুত্ব মেয়েটি তখন সহজ ভাবে মেনে নিতে পারে না। যা থেকে দুশ্চিন্তা, জটিলতা তৈরি হতে পারে।’’ এ ছাড়া কো-এড স্কুলে প্রথম দিকে ঋতুস্রাবের সময়েও মেয়েরা অস্বস্তিতে ভুগতে পারে।
পায়েল আরও বলছিলেন, ‘‘যে কোনও জায়গায় পড়া বা বড় হওয়া অভ্যাস তৈরি করে দেয়। যেমন, মেয়েদের সার্কলে এক ধরনের আলোচনা হয়। ছেলেদের পরিমণ্ডলে কথা বলার বিষয় এবং ধরন পুরোপুরি আলাদা। কো-এড স্কুলের ছেলেমেয়েদের নিজস্ব ‘কোড’ বা ‘সাইন ল্যাঙ্গোয়েজ’ থাকতে পারে। সেই আবহে প্রথম বার যখন কোনও মেয়ে বা ছেলে যাচ্ছে, তার নিজেকে গুটিয়ে রাখা অস্বাভাবিক নয়। ভাষাগত অন্তরায় টিনএজারদের বিড়ম্বনা বাড়িয়ে দেয়।’’
কী করবেন অভিভাবকেরা?
বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রথম ধারণা তৈরি হয় বাড়িতে। একটি মেয়ের কাছে তার বাবা এবং একটি ছেলের কাছে তার মা—বিপরীত লিঙ্গের প্রথম উদাহরণ। প্লেস্কুল বয়সে এই ফারাক নিয়ে শিশুদের তেমন ধারণা তৈরি হয় না। পরবর্তী কালে সামাজিক আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে অস্বস্তি তৈরি হবে কি না, তা আগে থেকে বলা মুশকিল। তবে সন্তানের কো-এড স্কুল বা কলেজে যাওয়ার আগে যদি অভিভাবকেরা নিজে থেকে কিছু বিষয়ে সচেতন হন, তাতে লাভবান হবে ছেলেমেয়েরা।
এমন কিছু টিপস দিলেন পায়েল:
টিউটোরিয়ালে কোনও মেয়ের দু’একটি ছেলে বন্ধু হলে, বাড়ির অনুষ্ঠানে বা গ্রুপ স্টাডিতে তাদেরও শামিল করা হোক।
কোনও ছেলে যখন প্রথম বার কো-এড স্কুলে যাচ্ছে, তখন কিছু ধারণা সম্পর্কে তাদের বুঝিয়ে বলে দিতে পারলে ভাল। যেমন, ঋতুস্রাবের সময়ে কোনও মেয়ে একা চুপ করে বসে থাকতে পারে ক্লাসে। তার সঙ্গে তখন সহমর্মিতার সঙ্গে কথা বলা, বা সামগ্রিক ভাবে মেয়েদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া, তাদেরও দলে শামিল করার মতো উপদেশ।
কোনও মেয়ে বা ছেলে যদি মা-বাবার সঙ্গে তাদের ‘ক্রাশ’ বা ভাল লাগা নিয়ে কথা বলতে চায়, তা মন দিয়ে শোনা। অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবারা বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কাউকে ভাল লাগা নিয়ে সন্তান হয়তো সিরিয়াস ছিল না। কিন্তু মা-বাবার প্ররোচনায় সে-ও জটিলতা বাড়িয়ে ফেলে।
কো-এড-এর সুবিধে
কো-এড স্কুলে পড়া খানিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ এনে দেয়। এতে ছোটদের সামাজিক পরিসরে শরীর নিয়ে ছুতমার্গও হয়তো কমে। বয়েজ় বা গার্লস স্কুলের ছেলেমেয়েদের সে সুযোগ প্রাথমিক ভাবে থাকে না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মেলামেশার পরিধি বাড়ে, পরিণত হয় বোধবুদ্ধিও। লিঙ্গ সম্পর্কিত বোধ তেমনই এক ক্রম-বর্ধমান সচেনতনতা যা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লালন করতে হয়।
মডেল: স্যমন্তক দ্যুতি মৈত্র, সঞ্চিতা সান্যাল, পূজিতা বন্দ্যোপাধ্যায়; মেকআপ: ভাস্কর বিশ্বাস; হেয়ার: কিশোর বিশ্বাস; ছবি: অমিত দাস; লোকেশন: ইকো হাব, রাজারহাট; ফুড পার্টনার: জুলি অ্যান্ড জুলিয়া লাইভ কাফে,
ডোভার টেরেস, বালিগঞ্জ