Dating App Real Experience

প্রেমের ফাঁদ পাতা ডেটিং অ্যাপে! বান্ধবীর খোঁজে গিয়ে বিপদ-হতাশার গল্প শোনালেন ৫ যুবক

ডেটিং মানে শুধুই কি মেয়েদের চিন্তা! অচেনা কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন পুরুষেরাও। ভালমন্দ অভিজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করলেন এমনই কয়েক জন যুবক।

Advertisement

সুস্মিতা মণ্ডল

শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:০৩
Share:

ডেটিং সাইটে পরিচয়, তার পর সাক্ষাৎ— অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নিলেন পাঁচ যুবক। ছবি: আনন্দবাজার অনলাইন

ঠোঁটে স্মিত হাসি। থুতনিতে তিল। এ মেয়ে কি আদৌ পাত্তা দেবে? মনে যখন আশা-আশঙ্কার দোলাচল দৃপ্তর (নাম পরিবর্তিত), সেই সময়ে হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠেছিল অ্যাপের মেসেজ বক্সে ‘হাই’ দেখে। তার পর বার্তালাপ। স্বপ্নের মতোই কাটছিল সময়। কিন্তু তিনি যে সত্যি সত্যি ছবির ‘ড্রিম গার্ল’-এর মতো বাস্তবে কোনও পুরুষ হতে পারেন, ভাবতেই পারেননি দৃপ্ত। শুধু দৃপ্ত নন, এমন অনেকেই আছেন। ডেটিং সাইটে এক মহিলাকে পছন্দ হয় আর এক যুবকের। সমস্যায় পড়েন প্রথম বার দেখা করতে গিয়ে। যাকে আজকাল শহুরে সংস্কৃতিতে ‘ডেট’ বলাই প্রচলিত। সেখানে গিয়ে দেখেন, বড় ফাঁদ অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। আর এক যুবক আবার বিবাহবিচ্ছেদের পরে সঙ্গীর সন্ধানে গিয়ে পান টাকার বিনিময়ে যৌনতার প্রস্তাব।

Advertisement

সাধারণত মহিলাদের বেশি সাবধান হতে বলা হয়, এমন অচেনা কারও সঙ্গে দেখা করা, কথা বলার ক্ষেত্রে। ধরেই নেওয়া হয় মেয়েদের বিপদ বেশি। কিন্তু প্রেমের ফাঁদে পা দিয়ে ডেটে গিয়ে বিপদে পড়ার ঘটনা পুরুষদের সঙ্গেও কম ঘটছে না। প্রেমের মরসুমে ডেটিং-আতঙ্কের কথা শোনালেন তেমন কয়েক জন যুবক।

প্রেম-ভালবাসার খোঁজে এখন অনেকেই ভরসা করেন ডেটিং অ্যাপে। সময়টা এমনই। অ্যাপে আলাপ, ফোনে কথা, তার পর কফি ডেটে যাওয়া, নতুন প্রজন্মের জীবনে এ সব এখন হয় অনেক তাড়াতাড়ি। টিন্ডার, আইল, বাম্বল, ট্রুলি ম্যাডলি, হিঞ্জ, ওকে কিউপিড— অনেকের মোবাইলে এখন থাকে এমন সব অ্যাপ। যেখানে নিজের ছবি দিয়ে প্রোফাইল খুলে সেখানে দিতে হয় সংক্ষিপ্ত বিবরণ। তা দেখেই নারী এবং পুরুষরা বেছে নেন পরস্পরকে। প্রথমে বার্তালাপ, তার পর ফোনালাপ। ভাল লাগা আরও এগোলে মুখোমুখি কফির কাপ।

Advertisement

সিনেমা দেখার সঙ্গীর খোঁজ থেকে জীবনসঙ্গী বাছাই— কারণ যা-ই হোক, কাউকে পাশে পেতে আজকাল অনেকেই নাম লেখান নানা রকম ডেটিং অ্যাপে। অজানা-অচেনা মানুষজনের সঙ্গে আলাপাচারিতা, দেখা-সাক্ষাতের এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ আছে ঠিকই। তবে এতে লুকিয়ে থাকে অজানা বিপদের ভয়ও। সাধারণত মহিলাদের সাবধান করা হলেও, পুরুষরাও কম সমস্যায় পড়েন না। অভিজ্ঞতা বলছে, ভাল ভাবে না চিনে বা জেনে কোনও মহিলার সঙ্গে দেখা করা ঝুঁকির হতে পারে। কারও সঙ্গে ফোনালাপ বা পরিচয় কিছুটা এগোনোর পরই ডেটে যাওয়া নিরাপদ। নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্যই তা প্রযোজ্য। কারও বাড়িতে নয়, বরং প্রথম দেখা হওয়া উচিত কোনও জনবহুল জায়গায়।

প্রেমের ফাঁদে পড়ে বেশি তাড়াহুড়ো করতে গেলে বিপদ যে ঘটতে পারে, টের পেয়েছিলেন হিন্দমোটরের অর্ক (নাম পরিবর্তিত)। তিনি অবশ্য একা নন, আরও অনেকে আছেন। কেউ সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে সময় কাটানোর হাতছানিতে ডেটে গিয়ে বিপদে পড়তে বসেছিলেন, কেউ আবার মহিলা ভেবে পুরুষের সঙ্গেই কথা বলে গিয়েছেন অনেক কাল। ফোনের ও পারে যিনি অ্যাপে মেসেজ করছেন মহিলা সেজে, তিনি আসলে এক জন পুরুষ। ডেটিং সাইটের এমন বর্ণময় জীবনের কথাই আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন ৫ জন। তাঁদের নিরাপত্তার প্রয়োজনে প্রকৃত পরিচয় গোপন রেখে ব্যবহার করা হল কাল্পনিক সব নাম।

সুন্দরী মহিলার ডাকে সাড়া দিয়ে মদ্যপানে যাওয়ার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন হিন্দমোটরের অর্ক। মন ছিল ফুরফুরে। কলকাতায় আসেন নির্ধারিত দিনে। দেখা করার কথা ছিল শপিং মলে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছেনার আগেই আসে বার্তা। তরুণী জানিয়েছেন, ভিড়ে না দাঁড়িয়ে কাছাকাছি একটি পানশালায় অপেক্ষা করছেন তিনি। অর্ককে ফোনে ঠিকানাও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

পানশালাটি খুঁজে পেতে দেরি হয়নি। তবে জায়গাটি দেখে একটু যেন ঝটকা লেগেছিল। দামি পানশালার বাহার, সামনে বসা খোলেমেলা পোশাকের তরুণী। সঙ্গে আবার তাঁর বান্ধবী। শুরুটা ঠিকই ছিল। তবে মেনু কার্ডে চোখ বোলাতেই ধাক্কা লাগার জোগাড় হয় অর্কের। খাবার থেকে পানীয় বেশ ব্যয়বহুল। তাঁর কথায়, ‘‘এর পর দেখলাম মেয়েটি আমার তোয়াক্কা না করেই বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলে পানীয়, খাবার অর্ডার করল। প্রথম বারেই যা খাবার বলেছিল, তাতে ৩-৪ হাজার টাকা বিল হয়। যা-ই হোক, কথাবার্তা চলছিল। তার ফাঁকেই লক্ষ করি, মেয়েটির মোবাইলে কিছু ক্ষণ অন্তর ফোন আসছে। তাতে নামের পাশে লেখা টিন্ডার, আইল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন কেটে দিলেও আড়চোখে আমি সবটাই দেখেছিলাম।’’

পান-ভোজন চলাকালীন প্রথম দফার পানীয় শেষ করে দুই তরুণী দ্বিতীয় দফায় মদ অর্ডার করেন। তার পরেই দু’জনে শৌচাগারে যাবেন বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। অর্কের কথায়, নানা কারণে ধীরে ধীরে সন্দেহ হওয়ায় ওই দু’জনের পানীয়ের গ্লাসে এক বার চুমুক দিয়েছিলেন। মনে হয়েছিল, ওতে কোনও মদ মেশানোই নেই। সাধারণ পানীয়। অর্ক বললেন, ‘‘ওরা ফিরতেই ধূমপানের নাম করে বেরিয়ে পড়ি। তত ক্ষণে দ্বিতীয় দফার অর্ডার মিলিয়ে বিলের অঙ্ক প্রায় ৫-৬ হাজার ছুঁয়েছে। নীচে নেমে উল্টো দিকে পানের দোকানে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিলাম। কিছু ক্ষণ পরে দেখলাম বার বার ফোন আসছে। আমাকে খোঁজাখুঁজিও শুরু হয়েছে।’’ তাঁর কথায়, পুরো বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় আমি পানের দোকানের লোকটির সঙ্গে গল্প শুরু করি। তখনই কথায় কথায় জেনেছিলেন, এই পানশালায় এ রকম কমবয়সি মেয়েরা মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ছেলেদের নিয়ে আসে। মোটা টাকা বিল করে, ওরা কমিশন পায়। অর্করও ধারণা হয়েছিলে, কৌশলে তাঁর পকেট ফাঁকা করার চেষ্টা হয়েছিল সে দিন। কোনও মতে তিনি পলিয়ে বেঁচেছেন।

অর্ক মনে করেন, ভুলটা হয়েছিল অ্যাপে আলাপের পর এক দিনের কথাতেই মেয়েটির প্রস্তাবে দেখা করতে রাজি হয়ে যাওয়া। তার পর থেকে নানা অভিজ্ঞতা হলেও ঝট করে আর কোনও মহিলার সঙ্গে দেখা করেননি। তবে ডেটিং সাইটের অভিজ্ঞতা শুধুই যে খারাপ, কিন্তু তা নয়। অর্কই জানাচ্ছেন, এই সাইট থেকে একাধিক বন্ধু পেয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কারও কারও সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কও তৈরি হয়েছে।

খুব তিক্ত ঘটনা না ঘটলেও সাবধানি অরিত্র। দমদমে বাড়ি। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। তাঁর পরামর্শ, ডেটিং সাইটে আলাপ হওয়ার পর অন্য সমাজমাধ্যমে তাঁরা প্রোফাইল রয়েছে কি না, দেখে নেওয়া দরকার। বেশ কিছু দিন কথা না বলে, একটু ভরসা-বিশ্বাসের জায়গা না তৈরি হলে দুম করে দেখা করতে যাওয়াটা ঠিক নয়।

ডেটিং সাইট নিয়ে খারাপ ধারণা না হলেও, কিছুটা হতাশ অরিত্র। জানাচ্ছেন, স্রোতে গা ভাসাতে নয়, পাকাপোক্ত সম্পর্কের সন্ধানে একটি ডেটিং সাইটে প্রোফাইল খুলেছিলেন। অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে। একাধিক মহিলার সঙ্গে ডেট করেছেন। তাঁর মনে হয়েছে, দু’পক্ষ চাইলে ডেটিং সাইট থেকে প্রেম-বিয়ে সম্ভব। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, তেমন কাউকে জীবনে পাননি। অরিত্রর অভিজ্ঞতা বলছে, সকলে সমান ভাবে মেশেন না। কেউ খোলা মনে মেশেন। কেউ বা খানিকটা ফুরফুরে সময় কাটাতে চান। কিন্তু সমস্যা হয় যদি উল্টো দিকের মানুষটিকে তা খুলে বোঝানো না হয়। কারণ, কেউ হয়তো আগামীর কথা ভেবেই সময় দিচ্ছেন অন্যকে। তাতে তাঁর সময় নষ্ট হয় যদি উল্টো দিকের মানুষটি তেমন না চান। ডেটে গিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা অরিত্রকে ভাবিয়েছে। বালির অর্ধেন্দু আবার বললেন, ‘‘ডেটিং সাইটে এমন অনেকের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, যাঁরা এখন ভাল বন্ধু। আবার অনেক সম্পর্ক ঠিক প্রেমের না হলেও বন্ধুত্বের থেকে বেশি হয়েছে। কখনও কেউ কেউ আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে বা পোক্ত সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়েছে। আবার ডেটিং সাইট থেকে জীবনে প্রেমও হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত দু’জনের মতের অমিলে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।’’ কথা হল, ডেট থেকেছে, প্রেম থাকেনি। তা খুঁজতেই গিয়েছিলেন। ভরসা ছিল তেমনই। কিন্তু যা পাওয়ার তা পাননি।

দক্ষিণেশ্বরের দৃপ্তর অভিজ্ঞতা আবার খানিক কঠিন। এক মহিলাকে পছন্দ করে মন ভেঙেছে তাঁর। কারণ, তিনি আসলে মহিলাই নন। দৃপ্ত বললেন, ‘‘প্রোফাইলে দেখছি সুন্দরী মহিলা। কথাও হচ্ছে। প্রাথমিক আলাপচারিতা হল। মোবাইলে লিখে কথা চলতে চলতে সমকামিতা, রূপন্তরকামীদের নিয়ে আমার মনোভাব জানার চেষ্টা হয়। আমি বলি, ঠিক-ভুলের কী আছে, যাঁদের যেটা মনে হচ্ছে, করছে। তার পর ধীরে ধীরে অন্য পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি মহিলা নন। আসলে তিনি পুরুষ। শারীরিক ভাবে পুরুষ হলেও তাঁর মধ্যে নারীসুলভ প্রবণতা রয়েছে। তিনি পুরুষদের সঙ্গেই সম্পর্কে যেতে চান।’’ দৃপ্ত জানান, আরও তিন জনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি। পরে তাঁরা নিজেরাই স্বীকার করেছিলেন, তাঁরাও পুরুষ। সমকামী। যুক্তিও দিয়েছিলেন, পুরুষের ছবি দিয়ে রাখলে, অন্য পুরুষ কথাই বলতে চান না। তাই বাধ্য হয়ে এই পন্থা নিয়েছেন।

খড়দহের কৌস্তুভ আবার বিবাহবিচ্ছেদের পর ডেটিং সাইটে প্রোফাইল খুলেছিলেন সঙ্গীর সন্ধানে। কিন্তু মনের মতো কাউকে পাননি। বরং খানিক হতাশ হয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম বিবাহিত মহিলারাও এখানে সঙ্গী খুঁজছেন। কেউ আবার বলছেন, এখান থেকে কারও সঙ্গে যদি প্রেম হয় বা দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরি হয়, তা হলে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ করবেন।’’ কৌস্তভ জানালেন, ডেটিং সাইটে ছবি দেখে পছন্দের পর কথোপকথন শুরু হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যে অর্থের বিনিময়ে যৌনতার প্রস্তাবও পেয়েছিলেন এক মহিলার কাছ থেকে। আবার কারও কারও সঙ্গে ভাল ভাবেই কথা এগিয়েছিল। তাঁর কথায়, ডেটিং সাইটটা তাঁর কাছে কিছুটা ভাগ্য অন্বেষণের মতো। ভাল হলে ভাল, কিন্তু মন ভাঙার আশঙ্কা অনেক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement