দু’চাকার দূষণহীন যানেই মুক্তির স্বাদ খুঁজছে শহরবাসী। গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ।
এ শহরে সাইকেলের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে দু’চাকার এই যানে চড়ার অনাবিল আনন্দ যে নতুন করে কলকাতাকে সাইকেলমুখী করে তুলছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। ব্যস্ত জীবন থেকে একটু সময় বার করে, সেই ভাল লাগা, রোমাঞ্চের টানেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ছেন অনেকে। হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে শহর ও লাগোয়া জেলার একাধিক সংগঠনও।
যে শহরের ৭৪টি রাস্তায় সাইকেল ব্রাত্য, সেখানেই প্রতি দিন প্যাডেলে পা রেখে স্বপ্ন দেখছেন অসংখ্য অসমবয়সি মানুষ। কেউ সাইকেলের হাত ধরেই খুঁজছেন বেড়ানোর আনন্দ। কেউ স্বপ্ন দেখছেন রোমাঞ্চের। কেউ চাইছেন আগামীর কলকাতাকে দূষণহীন, বাসযোগ্য করে তুলতে। কেউ আবার ‘নিখরচায়’ শহর লাগোয়া ছোট্ট অবকাশের গন্তব্যে পৌঁছে যেতে সওয়ার হচ্ছেন সাইকেলে।
শহর ও সাইকেল
সাইকেল এক এমন যান, যার রয়েছে চাকার গতির সঙ্গে ভারসাম্যের চমকপ্রদ রসায়ন। উপরি পাওনা, স্বাধীনতার আনন্দ। ১৮১৭ সালে জার্মানির ব্যারন কার্ল ভন ড্রেস আবিষ্কার করেছিলেন এই যানটি, যাতে প্রথমে প্যডেলই ছিল না। তাতে বসে পা দিয়ে মাটিতে চাপ দিয়ে ছক গড়াত। তার পর ক্রমশ ‘আধুনিক সাইকেল’ বলতে আমরা আজ যা বুঝি, তা নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে মূলত ইউরোপে তৈরি হয়। এর পরই দেশ থেকে দেশান্তরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সাইকেল। ১৮৮০-র দশকে তিলোত্তমায় এর আবির্ভাব। সাহেবি কলকাতাতেই তার বাড়বাড়ন্ত। শহরতলি থেকে গ্রামাঞ্চলে, ক্রমশ সাইকেল হয়ে ওঠে যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম। একটা সময় ছিল, যখন মানুষ প্রতি দিন ১০০ কিলোমিটারের উপর সাইকেল চালিয়েছেন প্রয়োজনের তাগিদেই। এখনও গ্রামাঞ্চলে যে তেমনটা হয় না, তা নয়। শহর ছাড়িয়ে শহরতলিতে গেলে এখনও প্রতিটি রাস্তায় শোনা যায়, সাইকেলের ক্রিং-ক্রিং ঘণ্টি। টোটো-অটোর দৌরাত্ম্যের মধ্যেও ফাঁকফোকর গলে দিব্যি চলে দু’চাকার যানটি।
সাইকেলেই মুক্তির আনন্দ। নিজস্ব চিত্র।
গতি আনতে গতিরুদ্ধ সাইকেল!
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতা শহরে বেড়েছে ব্যস্ততা। যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় কৌলীন্য হারিয়েছে দু’চাকার যানটি। গতি আনতে গতিরুদ্ধ হয়েছে সাইকেলের। তা নিয়ে আক্ষেপ, কলকাতা সাইকেল সমাজের আহ্বায়ক রঘু জানার। শহরের রাস্তায় সাইকেলের অবাধ বিচরণ ও নিরাপদে সাইকেল চালানোর জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মতো কলকাতাতেও পৃথক রাস্তার দাবিতে সরব সংগঠনটি। প্রবীণ মানুষটির কথায়, যে যান দূষণহীন, স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল, তাকেই আটকানো হচ্ছে? এ শহরের ৭৪টি রাস্তায় বন্ধ সাইকেল। অথচ এ নিয়ে ভাবলে শুধু যে মানুষের উপকার হত তা-ই নয়, পরিবেশ দূষণও কমত।
কোভিড দেখিয়েছে নতুন দিশা
পরিবেশ বান্ধব সাইকেল ভাল রাখে শরীর ও মন। গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ।
২০১৯ সালে কোভিড-১৯ এর কবলে পড়ে বিশ্ব। ২০২০ সালে ভারত দেখল প্রথম ‘লকডাউন’। থামল ট্রেনের চাকা। বন্ধ হল বাস,গাড়িও। ভয়ঙ্কর ভাইরাস থেকে বাঁচতে প্রয়োজন হল ছোঁয়াচ এড়ানোর। বাঁচার ও কাজের তাগিদে এ দেশ সাক্ষী হল দীর্ঘ সাইকেল যাত্রার। ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলার তাগিদে মফস্সলের
পাশাপাশি শহর কলকাতাতেও সে সময় ভরসা হয়ে উঠেছিল কৌলীন্য হারানো সাইকেলই। চারপাশে মৃত্যুমিছিল, বদ্ধ ঘরে দমবন্ধ করা জীবনে মানুষ চাইছিল প্রকৃতির সান্নিধ্য, মুক্তি। কোভিডবিধি লঘু হতেই, মন ভাল রাখতে ক্রমশ নতুন করে সাইকেলকে আঁকড়ে ধরতে শিখলেন এ শহরেরই বহু মানুষ।
সাইকেল নিয়ে সংগঠন
কলকাতার বুকে সাইকেল যাতে সদর্পে চলতে পারে, সাইকেল আরোহীদের নিরাপত্তা থাকে, ‘অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস’ হিসাবে প্রসার লাভ করে, তেমনই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে কলকাতা থেকে হাওড়া। এমনকি শহরতলিরও একাধিক সংগঠন। কলকাতা সাইকেল সমাজ, সাইকেল নেটওয়ার্ক গ্রো, সাইক্লোলজি ইন্ডিয়া, টু হুইলস কলকাতা, হাওড়া সাইকেল আরোহী, হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট মাউন্টেনিয়ার্স অ্যান্ড ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশন-সহ একাধিক সংস্থাই এখন সপ্তাহ শেষে বা প্রতি দিন সদস্যদের নিয়ে সাইকেলে ঘোরার পরিকল্পনা করে। কখনও শহরের মধ্যে, আবার কখনও শহরাঞ্চলের বাইরে। হইহই করে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ার মধ্যে অফুরন্ত আনন্দ। প্রকৃতি দেখা, সাইকেল চালিয়ে শরীরচর্চা, নিয়ম শেখা, খাওয়া, ছবি তোলা, গল্প— কী নেই সেখানে! কমবয়সিদের সঙ্গে বয়স্কেরাও দিব্যি তাল মেলাচ্ছেন। সেই দলে ভিড়ে নতুন রোমাঞ্চ খুঁজে নিচ্ছেন পড়ুয়া থেকে বধূরাও। সাইকেল নিয়ে ভ্রমণ নিছক ভ্রমণ না থেকে, হয়ে উঠছে সমাজ সচেতনতার বার্তাবহকও। জেলা, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে দু’চাকার দূষণহীন যান ছুটছে বহির্বিশ্বেও।
একাকী সাইকেল আরোহীর বিদেশ ভ্রমণ
কলকাতার সাইকেলের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই পাড়ি দেন লিপিকা বিশ্বাস। একসময় পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ নিয়ে ছুটে গিয়েছেন পাহাড়ে। সাফল্য মিলেছে। আবার এসেছে ব্যর্থতাও। পর পর দু’বার এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন ব্যর্থ হওয়ায়, হিমবাহ ধসে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে, নতুন করে বাঁচার তাগিদে নতুন স্বপ্ন দেখেছিলেন। একলা মহিলা সাইকেল নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন ইউরোপের ছ’টি দেশে। নারীশক্তির ক্ষমতায়নে দেশের মধ্যেই একাধিক বার সাইকেল নিয়ে অভিযানের পূর্বাভিজ্ঞতা ছিলই। তবে বিদেশ-বিভুঁইয়ে প্রথম বার! ভয় যে করেনি তা নয়। সমস্যাও হয়েছিল। জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট শহরে সাইকেল নিয়ে অভিযান শুরু করতে গিয়ে বিপত্তি। উড়ানে আনা বাক্সবন্দি সাইকেল কিছুতেই খাপে খাপে লাগে না। এ দিকে, সে দেশেও ঠিক সুবিধা না হওয়ায় অগত্যা নিজের বুদ্ধি কাজে লাগিয়েই সাইকেলে জোড়াতালি লাগিয়েছিলেন। তার পর সেই সাইকেলেই সংসার নিয়ে নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, আইসল্যান্ড পাড়ি। পরে শ্রীলঙ্কা সফরের পাশাপাশি আরও এক বার গিয়েছেন ইউরোপের অন্য ছয় দেশে। এ ভাবেই সাইকেলে দুনিয়া ঘোরার স্বপ্ন দেখেন কলকাতার লিপিকা। স্বপ্ন দেখানও সাইকেল নিয়ে রোমাঞ্চকর যাত্রার স্বপ্নও দেখান।
সাইকেলে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদেশ ভ্রমণ। নিজস্ব চিত্র।
সাইকেলের প্রচারে পাড়ি দেশান্তরে
সাইকেল শুধু স্বল্প দূরত্বের নয়, এতে চেপে দিব্যি পাড়ি দেওয়া যায় দেশ থেকে দেশান্তরে। সাইকেলে কাম্বোডিয়া থেকে থাইল্যান্ড যাওয়ার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলেন হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট মাউন্টেনিয়ার্স ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য এভারেস্টজয়ী মলয় মুখোপাধ্যায়। জানালেন, গত বছরেই গিয়েছিলেন দুই দেশে। যাত্রাপথে তাঁর সঙ্গী ছিলেন পার্থপ্রতিম হাজরা। ক্যাম্পিং-এর অভিজ্ঞতা থাকলেও, দীর্ঘ পথ সাইকেলে পাড়ি দেওয়া পার্থের জন্য প্রথম। তবে তাতে কোনও অসুবিধাই হয়নি।
দেশ ছেড়ে হঠাৎ বিদেশে সাইকেল ভ্রমণ কেন? পর্বতারোহী বললেন, ‘‘অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস হিসাবে ও দূষণহীন যান হিসেবে সাইকেলকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতেই এই পদক্ষেপ। তা ছাড়া, সাইকেলে চেপে বিদেশ ঘোরার আলাদা অনুভূতিও থাকে। সাইকেল নিয়ে গেলে, মানুষ অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে অভ্যর্থনা জানান।’’
কেমন ছিল সেই ‘ট্রিপ’? বিমানে চলে গিয়েছিলেন কাম্বোডিয়া। কাম্বোডিয়া থেকে থাইল্যান্ডের কোয়াই নদী পর্যন্ত ৪৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলেন সাইকেলে। বিখ্যাত আঙ্কোরভাট দেখে নেওয়ার জন্য সাইকেলের চেয়ে ভাল উপায় আর হতেই পারে না, মত মলয়ের। আগামী বছর আরও দু’টি দেশ সাইকেলে ঘুরে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। জানালেন, তাঁদের ক্লাবের পক্ষ থেকেই কলকাতা ও কলকাতার বাইরে বিভিন্ন জেলায়, এমনকি বাংলাদেশেও সাইকেলে করে ভ্রমণ করার বিভিন্ন কর্মসূচি থাকে।
সাইকেলেই ভালে ভাবে দেশ দেখা যায়, বলছেন সাইক্লিস্টরা। নিজস্ব চিত্র।
কোন টানে সাইকেল নিয়ে উৎসাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে?
হাওড়ার পাপিয়া। মেয়ে দ্বাদশের ছাত্রী। সংসারের পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসাও দেখেন। চারচাকাও চালান, আবার সাইকেলও। ছুটির দিনে হাওড়ার সাইকেল আরোহী দলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন তিনি। বললেন, এ ভাবে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ার মধ্যে ভীষণ আনন্দ কাজ করে। মেয়েকে নিয়েও বেরিয়ে পড়েন কখনও কখনও। এ নিয়ে চারপাশের লোকজন পাঁচকথা বললেও, পরিবার ভীষণ ভাবে সমর্থন করে।
দেশপ্রিয় পার্কের রোহন গায়েন। কলকাতা থেকে বকখালি গিয়েছিলেন টু হুইলস-কলকাতা নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রের কথায়, ‘‘দারুণ মজা হয়েছিল। সাইকেলে করে গেলে প্রকৃতিও দেখা যায়, ঘোরা যায়, শরীরচর্চাও হয়। সেটাই ভাল লাগে।’’
হইহই করে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ানোয় দারুণ আনন্দ। নিজস্ব চিত্র।
কলকাতায় সাইকেলের ভবিষ্যৎ কী?
দীর্ঘ দিন ধরে সাইকেল আরোহীদের নিরাপত্তা, কলকাতার বুকে পৃথক সাইকেল রাস্তার দাবিতে সরব কলকাতা সাইকেল সমাজ। ২০০৯ সালে সংগঠনটি তৈরি হয়। শুরু থেকেই কলকাতার সমস্ত রাস্তায় সাইকেল চালাতে দেওয়ার দাবিতে সই সংগ্রহ-সহ একাধিক প্রচারাভিযান হয়েছে। সংগঠনের আহ্বায়ক রঘু জানা জানালেন, ২০১৯ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় সাইকেলের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠানো নির্মাণের কথা ঘোষণা করেন। এর পরেই কেএমডিএ একটি বিশেষজ্ঞ সংস্থাকে সমীক্ষার দায়িত্ব দেয়। সেই সংস্থাটি এক বছর সমীক্ষা চালিয়ে কলকাতা শহরের জন্য সাইকেল নেটওয়ার্ক ও লেনের পরিকল্পনা জমা দেয় ২০২১ সালে। সাইকেল লেনের জন্য প্রয়োজন ছিল বড় রাস্তাগুলোর উপর গাড়ি পার্কিং বন্ধ করা। কিন্তু কলকাতা পুলিশের আপত্তিতে প্রস্তাবিত সাইকেল লেনের বাস্তবায়ন হয়নি।
কলকাতার মতো জনবহুল শহরে সত্যি কি পৃথক রাস্তা করা সম্ভব? সাইক্লিস্ট লিপিকা বিশ্বাস বলছেন, ‘‘কেন নয়? বেশির ভাগ রাস্তা জুড়েই তো বাইক, গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। সে সবের জন্যে মাটির নীচে বা অন্য কোথাও পার্কিং-এর ব্যবস্থা হলেই তো সাইকেলের জন্য রাস্তা বেরিয়ে আসবে। সরকারি ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল দিচ্ছে রাজ্য, অথচ সেই সাইকেল কোথায় চালাবেন আরোহীরা, সেটা কেন সরকার ভাববে না?’’
অন্যান্য সাইকেল সংগঠনেরও বক্তব্য, সদিচ্ছা থাকলে উপায় হতে পারে। সিএনজি-র প্রতিষ্ঠাতা আশিসের প্রশ্ন, বাইপাসের সম্প্রসারণ হলেও সাইকেল রাস্তার কথা তো কেউ ভাবলেন না? তাঁর কথায়, নিউ টাউনে সাইকেল রাস্তার নামে যেটা করা হয়েছে, তাতে কোনও লাভ নেই। রাস্তা জুড়ে নির্মাণসামগ্রী পড়ে থাকে। অটো, টোটোও রেখে দেওয়া হয়।
দু’চাকায় মুক্তির আনন্দ। নিজস্ব চিত্র।
রঘু জানা বলছেন, “নিউ টাউনে সাইকেলের জন্য পৃথক রাস্তা নয়, ওটা বলা যায় সৌন্দর্যায়নের একটি অংশ করা হয়েছে। এক প্রান্তের ওই রাস্তা সাইকেল আরোহীদের জন্যে মোটেই সুবিধাজনক নয়।” তবে কলকাতায় সাইকেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় থাকলেও, মুক্তির আনন্দেই যে ভবিষ্যতে সাইকেলমুখী হবে পরবর্তী প্রজন্ম, ক্রমবর্ধমান সাইকেল সংগঠনগুলির সদস্যদের সঙ্গে কথা বললে তেমন ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে।
চাইলে যে কেউ সাইকেল যাত্রার শরিক হতে পারেন। রইল কয়েকটি সংগঠনের হদিস:
সিএনজি
সাইকেলে শরীরচর্চার উপযোগিতার কথা মাথায় রেখে ২০১৬ সালে পথ চলা শুরু হয়েছিল সাইকেল নেটওয়ার্ক গ্রো-র, সংক্ষেপে সিএনজির। প্রতিষ্ঠাতা আশিস বাজাজ জানালেন, ৬-৭ জন নিয়ে শুরু করেছিলেন। এখন সেখানে রয়েছেন ১ হাজার ৮০০ জন সদস্য। সাইকেল চালালে শরীর ও মন দুই-ই ভাল থাকে। বিশেষত হাঁটুর ব্যথায় যাঁরা কষ্ট পান, তাঁদের জন্য সাইক্লিং খুব ভাল ব্যায়াম। সে কথা মাথায় রেখেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে উৎসাহ জোগায় সংগঠনটি। ছুটির দিনে মাঝেমধ্যেই তারা দলবদ্ধ ভাবে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ভিক্টোরিয়া তো থাকেই, এ ছাড়া বিশ্ব বাংলা গেট বা কলকাতার আশপাশে ২০-৩০ কিলোমিটার সাইক্লিং-এর কর্মসূচি থাকে। সাইকেল আর নিরাপত্তার জন্য টুপি ও প্রয়োজনীয় উপকরণ থাকলেই যে কেউ তাদের কর্মসূচিতে যোগ দিতে পারেন। সব সময় টাকাও লাগে না।
সাইক্লোলজি ইন্ডিয়া
কাছে-দূরে সাইকেল চালানোর পাশাপাশি কলকাতাতে ঘোরা-বেড়ানোর কর্মসূচি রাখে সাইক্লোলজি ইন্ডিয়া। সহ-প্রতিষ্ঠাতা যুধাজিৎ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘২০১৯ সালে ৩ জন মিলে সংগঠনটি শুরু করেছিলাম। চাকরি করতাম। সাইকেল চালাতে ভালবাসতাম। অবসরে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম। ভাল সাইকেল, মাথায় টুপি, নির্দিষ্ট পোশাক দেখে বহু মানুষ কৌতূহলী হতেন, প্রশ্ন করতেন। পরে এমন অনেকেই জুড়ে গিয়েছেন সংগঠনের সঙ্গে।’’ দূষণহীন যান হিসাবে সাইকেল নিয়ে সচেতনতার উদ্দেশে কাজ করছে সংগঠনটি। মানুষের সাড়া কেমন? যুধাজিতের কথায়, সাইকেল নিয়ে উৎসাহ ও অংশগ্রহণ বাড়ছে। ২০২৩ সালে দিঘা থেকে দার্জিলিং সাইকেল প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল সংগঠনটি। বিভিন্ন রাজ্য থেকেও বহু মানুষ সাড়া দিয়েছিলেন। চলতি বছরেও হবে। সকলেই যে শুধু প্রতিযোগিতার জন্য অংশ নিতে চাইছেন তা নয়, এর মধ্যে মিশে যাচ্ছে রোমাঞ্চ, উত্তেজনা, রাস্তায় চলার আনন্দ।
টু হুইলস-কলকাতা
সাইকেলের প্রসারে কাজ করে টু হুইলস-কলকাতা। মাঝেমধ্যেই কলকাতা ও আশপাশে সাইকেল নিয়ে দলবদ্ধ ভাবে যাওয়ার পরিকল্পনা করে তারা। থাকে সমাজ সচেতনতামূলক কর্মসূচিও। পরিবেশ বাঁচানো, ময়দান থেকে প্লাস্টিক সরানোর মতো নানা ভাল কাজে অংশ নিয়ে, সচেতনতার বার্তাও দেয়। সংগঠনের সদস্য অভিজিৎ জানালেন, ২০১৯ সালে সাইকেলের মতো দূষণহীন যান চালিয়ে একই সঙ্গে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যরক্ষার বার্তা দিতে কয়েক জন মিলে এগিয়ে এসেছিলেন। কোভিড পরবর্তী সময়ে প্রচুর মানুষ অংশ নিয়েছিলেন তাদের বিভিন্ন সাইকেল যাত্রায়। কলেজপড়ুয়া থেকে মধ্যবয়স্ক, প্রৌঢ় অনেকেই সঙ্গী হয়েছেন।
এই যে সাইকেল নিয়ে দূরপথে বেরিয়ে পড়া, জাতীয় সড়ক ধরেও তো যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তা? অভিজিৎ জানালেন, এক জন সাইকেল কো-অর্ডিনেটর থাকেন। তিনিই সমস্তটা দেখেশুনে ঠিক করেন। নিরাপত্তার খেয়াল রাখা হয়। টুপি থেকে হাঁটুর ক্যাপ, গ্লাভস— এই সমস্ত পরেই যাত্রা হয়।
হাওড়া সাইকেল আরোহী
বছর চারেক আগে জুলাই মাসে মাত্র তিন জনকে নিয়ে শুরু হয়েছিল হাওড়া সাইকেল আরোহী। এখন সাইকেল নিয়ে ঘোরার নেশা চেপে বসছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। জনপ্রিয়তা বেড়েছে সংগঠনের। পড়ুয়া থেকে বধূ, এমনকি বয়স্করাও সুবিধামতো তাঁদের বিভিন্ন দলবদ্ধ সাইকেল যাত্রায় অংশ নিচ্ছেন। সংগঠনের তরফে রাকেশ দাস জানালেন, ভিক্টোরিয়া, প্রিন্সেপ ঘাটে যাওয়া যেমন হয়, তেমন মাঝেমধ্যেই আশপাশের জেলাগুলিতেও বেরিয়ে পড়েন, যেমন বর্ধমান, হুগলি। মাঝেমধ্যে ১৫০-২০০ কিলোমিটার বা তার বেশিও সাইকেল নিয়ে দলবদ্ধ যাত্রার কর্মসূচি থাকে।
যে কেউ কি তাঁদের সংগঠনে যোগ দিতে পারেন? রাকেশের কথায়, “সাইকেল ভাল ভাবে চালাতে জানলে ২০ কিলোমিটার বা ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে যাত্রায় যে কেউ যেতে পারেন। তবে তার চেয়ে বেশি দূরত্বে যেতে গেলে আরোহীর অভিজ্ঞতা ও শারীরিক সক্ষমতাও দেখে নেওয়া হয়।”