বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকার যন্ত্রণা কম নয়! ছবি: সংগৃহীত।
পড়াশোনার জন্য হোক বা কর্মসূত্রে, বাড়ির বাইরে থাকতে হয় অনেককেই। চেনা ঠিকানা, পরিচিত পরিবেশ, বাড়ির পছন্দের কোণ, বারান্দা সব ছেড়ে আসা সহজ নয়। নতুন ঠিকানায় মানিয়ে নেওয়া আরও কঠিন। শুধু তো বাড়ি নয়, বাড়ির মানুষগুলিকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণাও তো কম নয়। কিন্তু ব়ড় কোনও স্বপ্নপূরণ করতে হলে বাড়ির চৌকাঠ পেরোতেই হয়। পাড়ি দিতে হয় বিদেশ-বিভুঁইয়ে। একটা মনখারাপ নদীর মতো সারা ক্ষণ মনের মধ্যে তিরতির করে বয়ে যায়। মনকেমনের মেঘ মাঝেমাঝেই ঝরে পড়ে চোখের কোল বেয়ে। বিশেষ দিনগুলিতে আরও বেশি জাঁকিয়ে বসে মনখারাপ। বাড়ি আর বাড়ির মানুষগুলির জন্য হঠাৎ মনখারাপের ঝড় উঠলে কী ভাবে তা সামলানো যায়? তার হদিস পেতেই আনন্দবাজার অনলাইনের ফেসবুক এবং ইউটিউব পেজে আলোচনায় বসলেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘লোকে কী বলবে’ অনুষ্ঠানের এ সপ্তাহের বিষয় ‘বাড়ির জন্য মনকেমন’।
প্রতি পর্বের মতো এ সপ্তাহেও বহু চিঠি পেয়েছেন মনোবিদ। নিজেদের মনকেমনের কথা লিখে জানিয়েছেন অনেকে। পর্বের শুরুতেই তানিয়ার চিঠি পড়লেন মনোবিদ। তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি এই বছর জানুয়ারি মাসে আমেরিকায় এলাম। আমি বরাবর আসতে চেয়েছিলাম। আমার কাছে এ যেন এক স্বপ্নপূরণ। কিন্তু এখানে আসার পর বিশেষ দিনগুলিতে বাড়ির জন্য আলাদা করে মনকেমন করে উঠছে। বাড়ির সকলেই পাশে আছেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমি তো তাঁদের পাশে থাকতে পারছি না। বিশেষ দিনগুলিতে ভীষণ ভাবে মনে হচ্ছে, ওঁদের কাছ চলে যাই। আবার বাড়ির কারও শরীর খারাপ করলে তখন তো পাশে থাকতে পারব না। সেই ভয়ও মাঝেমাঝে হয়।’’
মধুরা যেমন জানিয়েছেন, পড়াশোনার সূত্রে বিদেশে থাকেন। পুজোর সময়ে কলকাতায় এসেছিলেন। বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে মজা করেছেন। পুজোর পর মাকে সঙ্গে নিয়েই বিদেশে ফিরেছিলেন। কালীপুজোর আগের দিন মা আবার ফিরেও এলেন। মা চলে আসার পর সেই রাতটা একেবারে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। তার পর থেকে অসম্ভব একা লাগতে শুরু করে। কাজে ফেরার উদ্যম পাচ্ছিলেন না।
তানিয়া, মধুরাদের মতো এমন অনেকেই বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকার মনখারাপের কথা লিখেছেন। আবার চিঠি লেখেননি, কিন্তু এই পর্ব দেখতে দেখতে ভেবেছেন এ তো তাঁরই গল্প। অথচ বাড়ি থেকে দূরে থাকার ভয় সকলেই একেবারে ছোটবেলাতে পেয়েছিলেন। প্রথম স্কুল যাওয়ার সময় মুখে হাসি ছিল, এ বড় বিরল। বাবা কিংবা মায়ের হাত ধরে স্কুলে ঢোকার পরেও পিছন ফিরে বাচ্চারা দেখে নেয়, বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছেন কি না। আসলে যিনি ছেড়ে গেলেন, পিছন ফিরে আরও এক বার তাঁকে দেখে নেওয়া এক সহজাত অভ্যাস। সেই সূত্র ধরেই মনোবিদের পরামর্শ, ‘‘বাড়ি ছেড়ে থাকার এই উদ্বেগ আসলে আদিম। অনেক অনেক বছর ধরে সেই ভয় আমাদের সঙ্গে পথ হেঁটেছে। কখনও তা খুব প্রকট হয়ে উঠেছে। কখনও অত প্রকট ভাবে টের পাইনি। আসলে আমরা যা ছেড়ে আসি, মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করে যে ফিরে গিয়ে ঠিক আগের মতোই সব কিছু থাকবে তো! তবে শিশুর বুদ্ধির বিকাশ অত দ্রুত হয় না। ফলে তারা বুঝতে পারে না যে যা চোখের আড়াল হয়, তা থেকেও যায়। বয়স বাড়লেও অনেক সময় এই মনখারাপ কাটতে চায় না। আসলে সেই ছোটবেলার আমিটা যেন অনিশ্চয়তা, সংশয় নিয়ে পরিণত আমিকেও আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। তাই এমন হয়। এগুলি কাটিয়ে উঠতে হবে। মনকে বোঝাতে হবে। ছোটবেলার মতো অসহায়তা আর নেই। মনখারাপ কাটানোর অনেক উপায়ও আছে এখন। নিজেকে বোঝাতে হবে।’’