‘চৈত্রসংক্রান্তির গায়ে যেন একটা অদ্ভুত বিরহের গন্ধ মিশে আছে।’
কোনও কিছুই স্থায়ী নয়, তবু হারিয়ে ফেলার একটা বোধ প্রতিনিয়ত জড়িয়ে থাকে। তাকে ভয় বলব নাকি আতঙ্ক – জানি না। কেবলই আঁকড়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। সময় যে পেরিয়ে যাবে, ছোট-বড় চাওয়া, পাওয়া, না-পাওয়াগুলো একটু একটু করে দূরে সরে যাবে— তা অজানা নয়। তবু মেনে নিতে কষ্ট হয়। জীবন বদলে যায়। ব্যক্তিগত হোক বা সার্বিক। মানিয়ে নিতে হয়। নিরন্তর বদলে চলা মূল্যবোধের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে মেলাতে হয়তো কখনও কখনও ক্লান্ত মনে হয়। তবু নতুনের কাছে একটা আশা জেগে থাকে।
চৈত্রসংক্রান্তির গায়ে যেন একটা অদ্ভুত বিরহের গন্ধ মিশে আছে। একটা গোটা বছরের স্বপ্ন, স্বপ্নপূরণ, স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে সে হেঁটে চলে যায় চেনা পর্দা সরিয়ে। নতুন বৈশাখের দিকে এগিয়ে চলা আলোর কাছে হয়ত আবার নতুন কিছু প্রত্যাশা তৈরি হয়। হয়ত বা সে অন্য কিছু দেবে। যা পেতে চাই, অথচ পাওয়া হয়নি কোনওদিন। পেরিয়ে আসা পুরনো বছরের থেকে সে আলাদা। ভালো অথবা খারাপ– সে প্রসঙ্গ তো আপেক্ষিক। নতুন ক্যালেন্ডারের পাতায় আগামী দিনগুলো রঙিন হয়ে ফুটে ওঠে চোখের সামনে। জীবনে যে শব্দগুলো লিখে উঠতে পারিনি, যা দিয়ে অনায়াসে গড়ে উঠতে পারত নতুন কবিতা বা কাহিনি; জীবনে যে শটগুলো নিতে চাই, নেওয়া হয়ে ওঠেনি, যা দিয়ে তৈরি হয়ে উঠতে পারে নতুন ছবি– তার সামনে দু’হাত পেতে দাঁড়াই একটা নববর্ষ কাছে এলে।
দিন আসে, দিন যায়। সাল, তারিখ, দিনক্ষণ– এসব টুকরো টুকরো পৃথিবী আমাদেরই তৈরি করা। প্রতিনিয়ত তা বদলে বদলে যায়। একটা বছর শুরু হয়, এগিয়ে যায়, ফুরিয়েও যায়। আবার একটা নতুন বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়... নতুন তারিখ, নতুন তিথির অপেক্ষা। বাংলা নববর্ষ এলে নস্ট্যালজিক লাগে খুব। ছোট থেকে ক্রমশ বড় হয়ে ওঠার মুহূর্তগুলোয় বাংলা নতুন বছর আসত বাড়িতে সকলে মিলে একটা গোটা দিন একসঙ্গে কাটানোর মধ্যে দিয়ে। নতুন কেনা পোশাক, মায়ের হাতের রান্না, নতুন বইয়ের গন্ধে ম ম করত চারপাশ। নতুন বই, নতুন গান, নতুন সিনেমা– একটা নতুন বছর যেন অনেকগুলো নতুনের মালা।
নববর্ষ মানে গ্রীষ্ম আসছে। কোকিলের ডাক শুনতে শুনতে হঠাৎ-ই বিকেল জুড়ে কালবৈশাখী। নববর্ষের শুরুতে খুব জানতে ইচ্ছে করে, মানুষ কেমন আছে গ্রীষ্মের শহরে! আসলে ‘কেমন আছো’– জানতে চাওয়ার মানুষের বড় অভাব। পরিবর্তনশীল সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে জীবন এখন ক্লান্ত। আর বাংলা নববর্ষ নিয়ে একদিনের আড়ম্বরকে ‘বাঙালির হুজুগ’ ছাড়া কী বা বলা যায়– জানা নেই। বাবা-মায়েরা গর্বের সঙ্গে এখন বলেন– ‘আমার বাচ্চার বাংলাটা ঠিক আসে না’। বাংলা ভাষা-সাহিত্য পড়তে চাইলে মানুষজনের তামাশা আর কটাক্ষে ভরে ওঠে প্রাপ্তির ঝুলি। বাংলা ভাষায় কবিতা, গল্প লিখতে এসে ক্রমাগত শুনেছি– ‘বাংলায় লেখ? কেন? অন্য ভাষাতেও তো লিখতে পারতে!’ যেন মাতৃভাষায় লেখাটা অপরাধ। বাংলা ছবি বানাব ভেবে কাজ শুরু করার পর তথাকথিত ‘বাঙালি বুদ্ধিজীবি’-র কাছে শুনেছি– ‘সিনেমা বানাবে, কিন্তু বাংলায় কেন?’ এসব কথা শুনতে শুনতে আর চারপাশ দেখতে দেখতে মনে হয়, ‘বাংলা’ শব্দটাই যেন বাঙালির কাছে ক্রমশ তাচ্ছিল্যের বিষয় হয়ে উঠছে। সেখানে দাঁড়িয়ে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে সত্যি মাঝে মাঝে দেখনদারি বলে মনে হয়। তবু এখনও কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা বাংলা ভাষা-সংস্কৃতিকে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরে বাঁচেন, তার পরিচর্যা করেন—সেটুকুই আশার, সেটুকুই স্বপ্নের।
আমি সময়কে বিশ্বাস করি। সে যেমন কেড়ে নেয় বহু জিনিস, তেমনই ফিরিয়ে দেয় অনেককিছু। একটা ভাইরাসের কবলে পড়ে গোটা পৃথিবী আজ অসুস্থ। অনবরত যুদ্ধ করে চলেছে মানুষ। যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হচ্ছে, হেরে যেতে যেতে আবার নতুন দিনের স্বপ্ন দেখছে। বাংলা নববর্ষে আশা রাখি—পৃথিবী সেরে উঠুক। নতুন বছরের সকাল মানে অসংখ্য শুভেচ্ছাবার্তায় উপচে পড়া ইনবক্স। নববর্ষ আমার কাছে আন্তরীক শুভেচ্ছা ও মঙ্গল কামনা। নতুন কিছু করার শপথ গ্রহণ। তারপর আবার সেই সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে বিকেল, সন্ধে, রাত... আরও একটা নববর্ষের প্রতীক্ষা, একটা নতুন বৈশাখের সূচনা।