অনন্যসাধারণ: যামিনী রােয়র কাজ। সম্প্রতি চারুবাসনা গ্যালারিতে
গত পঞ্চাশ বছরে শুধু মাত্র যামিনী রায়কে নিয়ে যত গ্রন্থ, পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে, সেমিনার, আলোচনা, বক্তৃতাসভা, প্রদর্শনীর আয়োজন হয়েছে, ভারতীয় কোনও চিত্রকরকে নিয়ে তত কাজ খুবই কম হয়েছে। যামিনী রায় আজও শিল্পসাহিত্য-রসিক মহলে এতটাই প্রাসঙ্গিক। যদিও তাঁর শিল্পকর্ম নিয়ে যে পরস্পর-বিরোধী মতামতও ব্যক্ত হয়নি, তা নয়। সম্প্রতি কলকাতার বুকে তাঁর ৫২টি ক্ষুদ্র ও অপেক্ষাকৃত বড় ড্রয়িং ও স্কেচ বা খসড়া জাতীয় কাজের একটি অসাধারণ প্রদর্শনী সম্পন্ন হল চারুবাসনা গ্যালারিতে। যা উপস্থাপন করেন— উদ্বোধনের দিনেই প্রকাশিত ‘ক্যান্ডিড স্কেচেস অব যামিনী রায়’ বইটির সম্পাদক জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য। স্কেচগুলির অধিকাংশই প্রশান্ত তুলসীয়ান ও জ্যোতির্ময়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ এবং নানা সংগ্রহ থেকে নিয়ে প্রদর্শিত।
জীবিত কালে নয়, যামিনীবাবুর মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই এই জাতীয় স্কেচ, ড্রয়িংয়ের একটি প্রদর্শনী তাঁর নিজস্ব গ্যালারিতে আয়োজন করেছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। চিত্রকূট গ্যালারিতে আয়োজিত ছবির প্রদর্শনীতে দু’-চারটি এ ধরনের কাজ দেখা গেলেও এত কাজ একসঙ্গে এ ভাবেই প্রথম দেখা গেল। যার সবই ছোট স্কেচ, খসড়া, ড্রয়িং।
অতি সাধারণ, অপ্রয়োজনীয়, প্রায় ফেলে দেওয়া বাতিল কাগজ বা ওই জাতীয় কোনও পুরনো খাম, বিভিন্ন আমন্ত্রণপত্র, কার্ড, এমনকি সংবাদপত্রের ফাঁকা অংশেও কাজগুলি করেছেন। যখন যেমন মনে করেছেন, দ্রুত স্কেচ করেছেন। দু’-একটি ছাড়া কোনও কাজেই তাঁর নাম সই করেননি, তারিখও নেই, প্রয়োজন মনে করেননি। আসলে অতি দ্রুত টানটোনের এ সব স্কেচ ও রেখাঙ্কনের রচনাগুলি দেখলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, হয়তো বা তাঁর কোনও ছবির খসড়া বা লে আউট। এই বিভ্রম হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। অনেক স্কেচেই অবয়বের ভঙ্গি, নাক, চোখ-মুখ, সামান্য বঙ্কিম ভাব, ঈষৎ পাশ ফেরা মুখ বা শরীর দেখলে মনে হতে পারে, তাঁর পেন্টিংয়ের খসড়া হয়তো বা। আসলে যে লৌকিক পটপ্রধান স্টাইল বা পৌত্তলিকতার লোকশিল্পগত অবয়ব বা রূপারোপ তাঁর ছবির প্রধান বৈশিষ্ট্য, স্বাভাবিক ভাবেই সেই সব ড্রয়িংয়ের সঙ্গে এ সব স্কেচের সামঞ্জস্য আছে বইকি। কাগজে এত বেশি পুরনো, হলদেটে বা বাদামি ভাব এসে গিয়েছে যে, পেন, কালির সে গাঢ়ত্বও আর নেই। স্পষ্ট কিন্তু প্রখর ঔজ্জ্বল্য নষ্ট হয়েছে।
সবই অবয়বপ্রধান নারী-পুরুষের ড্রয়িং। পশুপাখিও আছে। দ্রুত স্কেচে সামান্য কিছু আঁচড়, রেখার অমন সাবলীল, কাব্যিক ও দৃঢ় গতি কিন্তু অনুভূত হয়। কোনও কোনও স্কেচ ছোট্ট ব্লক করে ছেড়ে দিয়েছেন। একসঙ্গে অনেক মানুষের সংগঠন বা একজন প্রভু গোছের কাউকে ঘিরে সমাবেশ, আবার বাজনা বাদকের দল। তেমনই পৌত্তলিকপ্রধান স্কেচ, মাথা বড়, শরীর ছোট, যৎসামান্য টানটোন আর কিরিকিরি রেখার ঘষামাজা। টানা চোখের নারী নৃত্যরত ভঙ্গিতে বেশ একটা জ্যামিতিক প্যাটার্নের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আবার একাকী নতমস্তক ও জননীস্নেহে শিশুক্রোড়ে দাঁড়ানো ভঙ্গিটিও চমৎকার। এগুলো সবই সামান্য কিছু রেখার বিন্যাসে গভীর স্কেচ।
কিছু কাজে ভাস্কর্যীয় গড়নের মতো কোথাও কোথাও ভলিউমকে রেখে ড্রয়িং করেছেন, রেখাপ্রধান সেই কাজ মাত্র পাঁচ-ছ’টি লাইনেই শেষ করেছেন। মুখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া টানা সরু চোখ, মধ্যিখানে গোল সলিড চোখের ক্ষুদ্র মণি, আবার কপালে তিলক কাটা মাথায় বর্তুল ঝুঁটি, পুতুলপ্রধান চরিত্রকেও এঁকেছেন। সামান্য লাইনে ক্রুশ দু’হাতে জড়িয়ে দাঁড়ানো যিশুমূর্তির পাশেই পুতুলসম দেবীমূর্তি, আবার খুব ছোট সমান্তরাল ভাবে অত্যন্ত দ্রুতগতির রেখায় স্কেচ করেছেন বংশীবাদক শ্রীকৃষ্ণের পাশে প্রায় অবগুণ্ঠিতা রাধা। তবে এক পাশে লাফিয়ে এগিয়ে চলার মুহূর্তে সিংহের উপরে চতুর্ভুজা দেবীর স্কেচটি অন্য রক। সিংহের নীচে লম্বা বসে থাকা হাতি, যার পিঠে সিংহের দেবী-সহ অবস্থান। পিছনে চালচিত্রের মতো কয়েকটি রেখার আভাস। এই কাজটিতেও সেই বেরিয়ে থাকা টানা চোখ।
চরিত্রের ভঙ্গি-বৈচিত্রে পৌত্তলিক ভাব ও লোকশিল্পের ঘরানাও এ সব স্কেচে বারবার অনুভূত। এমন প্রচুর স্কেচ ও ড্রয়িংয়ের সমাহার প্রদর্শনীটিকে নিঃসন্দেহে একটি আলাদা মাত্রা দিয়েছে।