জীবনযাত্রার বদলই রুখবে হাঁটু প্রতিস্থাপনের আশঙ্কা

উপরের ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, এখন হাঁটুর সমস্যায় বয়সটা কেবলই সংখ্যা। যত দিন যাচ্ছে, নিয়ম করে ঘরে ঘরে বাড়ছে হাঁটুর অসুখ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা অস্টিওপোরেসিস।

Advertisement

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৭ ১৩:২৫
Share:

বছর চল্লিশের গৃহবধূ সুতপা বসু। হাঁটুর ব্যথায় বন্ধ হতে বসেছে হাঁটাচলা। বাড়াবাড়ি হওয়ার পর চিকিৎসক নিদান দিলেন হাঁটু প্রতিস্থাপনের।

Advertisement

৮২ বছরের অমিত সরকার। প্রাক্তন ট্রামচালক। জীবনভর সুস্থ থাকলেও, বয়সকালে হাঁটু অকেজো। বাধ্য হয়ে প্রতিস্থাপন করতে হল হাঁটু।

বছর সাতাশের অমৃতা দত্ত। তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। দিনের অনেকটা সময় চেয়ারে বসে থেকে কাজ। এই বয়সেই হাঁটুর ব্যথায় কাহিল। প্রতিস্থাপন ছাড়া উপায় রইল না।

Advertisement

উপরের ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, এখন হাঁটুর সমস্যায় বয়সটা কেবলই সংখ্যা। যত দিন যাচ্ছে, নিয়ম করে ঘরে ঘরে বাড়ছে হাঁটুর অসুখ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা অস্টিওপোরেসিস। প্রথমটায় ক্ষয়ে যাচ্ছে হাঁটুর সংযোগস্থলের তরুণাস্থি, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ক্ষয়ে যাচ্ছে হাড়। তবে নাম যা-ই হোক না কেন, সব ক্ষেত্রেই চিকিৎসার চূড়ান্ত ধাপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, হাঁটু প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার। কয়েক বছর আগেও যা সাধারণত ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল, এখন তা-ই জলভাত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, নির্দিষ্ট কোনও অসুখ নয়। ‘লাইফস্টাইল ডিসঅর্ডার’-ই এর মূল কারণ। অর্থোপেডিক প্রশান্ত পূজারি যেমন স্পষ্ট বলছেন, ওজনের ওপর নিয়ন্ত্রণ না-থাকা এবং পরিশ্রম না-করাটা বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সমস্যার। তাঁর কথায়, ‘‘এখন ঘরের সঙ্গে লাগোয়া থাকে শৌচাগার। একটু উঁচু বাড়ি হলেই লিফট আবশ্যিক। বাইরে যেতে গেলেও হেঁটে বাসস্ট্যান্ড অবধি যাওয়ার বদলে বাড়ির দরজায় ক্যাব ডেকে নিতে শিখেছেন মানুষ। ন্যূনতম পরিশ্রমের সুযোগ কোথায়! সময়ই বা কোথায় নিয়মিত শরীরচর্চা করার।’’

এর সঙ্গেই রয়েছে, পরিবার ছোট হয়ে যাওয়ার সমস্যা। কিছু দিন আগে পর্যন্তও বয়স্ক দাদু-ঠাকুরমার হাত ধরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সান্ধ্যভ্রমণ করানোর দৃশ্য চোখের আরাম দিত। ইদানীং সে দৃশ্য বিরল। বয়স্করা একা থেকে আরও একা হয়ে পড়ছেন। তাই যে হাঁটুর সমস্যা স্পর্শে আরাম পেত, যত্নে নিরাময় হত, তা-ই এখন হামেশা পৌঁছচ্ছে প্রতিস্থাপনের দোরগোড়ায়।

অর্থোপেডিক রামেন্দু হোমচৌধুরী আবার বলছেন, ‘‘মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। সেই সঙ্গে, গত তিরিশ-চল্লিশ বছরে আমূল পরিবর্তন এসেছে মানুষের যাপনে। তাই এ সব সমস্যাও অনেক বেশি সামনে আসছে।’’ তিনি জানালেন, অনেকেই বুড়ো বয়সে একা ভুগতে হবে, এই আশঙ্কায় আগাম করিয়ে রাখছেন হাঁটুর প্রতিস্থাপন।

তবে ঘরে ঘরে হাঁটুর এই সমস্যার সমাধানে প্রতিস্থাপন যতটা না জরুরি, তার চেয়ে বেশি জরুরি জীবনযাত্রায় বদল আনা। ‘‘রোজকার চলাফেরা, ওঠাবসায় কিছু বিধি-নিষেধ মানলেই ৯০% ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয় না। এমনিই ভাল থাকে হাঁটু।’’— বলছেন রামেন্দুবাবু।

কী সেই বিধি-নিষেধ?

রামেন্দুবাবু জানাচ্ছেন, বেশি সময় ধরে মাটিতে না-বসা, কমোড ব্যবহার করা, ঘুম থেকে ওঠার সময় কাত হয়ে ওঠা, ঝুঁকে বা দাঁড়িয়ে স্নান না-করে টুলে বসে করা, এক জায়গায় অনেক ক্ষণ বসে টেলিভিশন বা কম্পিউটার না-দেখা, বেশি উঁচু এবং সরু হিলের জুতো না-পরা— এগুলি মেনে চলা জরুরি। এ ছাড়াও রোজকার খাদ্যতালিকায় থাকুক মাছের তেল। স্বাস্থ্য সচেতনতার কারণে তেল বর্জন করতে গিয়ে, অতি প্রয়োজনীয় ‘ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড’-ও বাদ চলে যাওয়ায়, হিতে বিপরীত হচ্ছে বলে মত তাঁর।

অর্থোপেডিক রণেন রায়ের মত, সমস্যা চিরকালই ছিল। হাঁটুর ব্যথায় বুড়ো বয়সের কষ্ট নতুন কিছু নয়। কিন্তু সচেতনতা আর টাকা এত ছিল না সাধারণ মানুষের। তাই ইদানীং কালে, সমস্যা হলেই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া এবং সর্বোত্তম চিকিৎসা নিতে শিখছে মানুষ। তবে একই সঙ্গে তিনি বলছেন, ‘‘এখন অনেক কম বয়সেও মানুষ ভুগছেন। হাড়ের সঠিক পুষ্টির অভাব এবং জীবনযাত্রায় শৃঙ্খলার অভাবই এর কারণ।’’

কলকাতায় হাঁটু প্রতিস্থাপন শুরু মূলত যাঁর হাত ধরে, সেই প্রবীরকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়েরও মত, সচেতনতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ফলে ঝোঁক বেড়েছে অস্ত্রোপচারে। সেই সঙ্গেই দিনকে দিন সহজ ও উন্নত হচ্ছে অস্ত্রোপচার। ফলে একটু সুস্থ জীবনযাপন চেয়ে পাকাপাকি ভাবে হাঁটু সারিয়ে নিতে চাইছেন অনেকেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement