হঠাৎ চোখে ঝাপসা দেখছি— এটা শুনলে অনেকেরই প্রথমে মনে হয়, শুধু চোখেরই সমস্যা। বেশির ভাগ সময়ে চোখে কিছুটা জল বা আই ড্রপ দিলে বা দু’-এক বার চোখ খোলা-বন্ধ করলেই দৃষ্টিশক্তি আবার ঠিক হয়ে যায়। কখনও আবার কাছের বা দূরের পাওয়ারের চশমায় লুকিয়ে থাকে সমাধান। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এই হঠাৎ ঝাপসা দেখার নেপথ্যে থাকে নানা শারীরিক সমস্যার লক্ষণ।
যে সব কারণে হতে পারে
চিকিৎসক সুবীর মণ্ডল বললেন, “চোখে আলো পড়ার পরে তা ক্রমে কর্নিয়া, লেন্স পূর্ববর্তী প্রকোষ্ঠ, লেন্স ও তার পরবর্তী প্রকোষ্ঠে প্রতিসৃত হয়ে রেটিনায় প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে। এইগুলির কোথাও অস্বাভাবিক পরিবর্তনে আমরা ঝাপসা দেখি। তবে মূলত চোখের কনজাংটিভা বা কর্নিয়া কোনও কারণে শুকিয়ে গেলে এই সমস্যা দেখা দেয়। আবার চোখ থেকে প্রতিবিম্বের সঙ্কেত মস্তিষ্কে যদি ঠিক ভাবে না পৌঁছয়, তখনও ‘ব্লার্ড ভিসন’ বা ঝাপস চোখের সমস্যা দেখা দেয়।”
চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ সুমিত চৌধুরী বললেন, “অনেক সময় জন্মগত কোনও কারণে ছোটদের চোখে পাওয়ার আসতে পারে। এ ছাড়াও, অতিরিক্ত বেশি ‘স্ক্রিন টাইমের’ ফলে চোখের ‘নিয়ার ভিশনের’ উপরে প্রভাব পড়ে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্লকোমা, ছানি পড়ার মতো চোখের সমস্যা দেখা দেয়। এর ফলেও দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে। বাড়ে ঝাপসা দেখার প্রবণতা।
কিন্তু, কাজের মাঝে হঠাৎ করে যখন দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়, তখন অবশ্য সমস্যাটি কিছুটা অন্য রকম হতে পারে। যেমন:
- মাথায় আঘাত লাগা বা ব্রেন টিউমর: অনেক সময় পড়ে গিয়ে বা অসাবধানতাবশত মাথায় চোট লাগে। এর ফলে যদি চোখের ‘অপটিক নার্ভ’ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা হলে দৃষ্টি ঝাপসা হতে পারে। অনেক সময়ে ঝাপসা দৃষ্টি ব্রেন টিউমরের ইঙ্গিতও হতে পারে। এ সব ক্ষেত্রে, মাথাযন্ত্রণা, ঝাপসা দেখা ছাড়াও বমি হওয়া, খিটখিটে হয়ে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। মাথায় আঘাত লাগলে বা এই ধরনের উপসর্গ বেশ কিছুটা সময় ধরে দেখা দিলে অবশ্যই সিটি স্ক্যান করানো জরুরি।
- উচ্চ রক্তচাপ: এই সমস্যাটিকে উপেক্ষা করেন অনেকে। কিছু ক্ষেত্রে আবার অবহেলার ফলে রোগ নির্ণয়েও কিছুটা দেরি হয়। কিন্তু ‘সাইলেন্ট কিলার’ এই রোগের প্রভাবে আচমকা ঝাপসা দেখতে পারেন অনেকে। পথে-ঘাটে চলা ফেরায় হতে পারে সমস্যা। কিছুটা একই সমস্যায় ভুগতে পারেন গর্ভবতীরাও। এই সময় হঠাৎ করে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে অতিরিক্ত মাথাযন্ত্রণা থেকে আচমকা দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। ডা. সুবীর মণ্ডলের পরামর্শ, “যদি গর্ভাবস্থায় কোনও মহিলা চোখে অন্ধকার দেখেন বা দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসে, তা হলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে, হাইপোটেনশন বা রক্তের নিম্নচাপের শিকার যাঁরা, তাঁদেরও এই সমস্যা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে একই সঙ্গে অতিরিক্ত দুর্বলতা ও জ্ঞান হারানোর মতো উপসর্গও দেখা যেতে পারে।”
- ডায়াবিটিস: যাঁরা ডায়াবিটিসে ভোগেন, তাঁদের অনেকের মধ্যেই হাইপোগ্লাইসেমিয়া সমস্যা দেখা দেয়। অর্থাৎ, হঠাৎ করে সুগারের মাত্রা ‘ফল’ করে। এর ফলে ব্লার্ড ভিশন হতে পারে। এর সঙ্গে অতিরিক্ত ‘কোল্ড সোয়েটিং’ হয়। অর্থাৎ চোখে ঝাপসা দেখার পাশাপাশি অতিরিক্ত ঘাম হওয়া ও জ্ঞান হারানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। অবশ্য, যাঁরা ডায়াবিটিসের শিকার, সময়ের সঙ্গে তাঁদের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। তাই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে। চিকিৎসকের পরামর্শ, কোনও ডায়াবিটিস রোগী যদি আচমকা চোখে ঝাপসা বা অন্ধকার দেখেন, তবে দ্রুত তাঁর শরীরে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
- মাইগ্রেন বা ক্লাস্টার হেডেক: মাইগ্রেনের সমস্যায় যাঁরা ভোগেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেরই ঝাপসা দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে। মাইগ্রেনের যন্ত্রণা কিছু ঘণ্টা থেকে প্রায় দু’-তিন দিন পর্যন্ত চলতে পারে। এই সময় অতিরিক্ত আলো বা আওয়াজের ফলে মাথা যন্ত্রণার পাশাপাশি ঝাপসা দেখা বা ‘লাইট ফ্ল্যাশ’ দেখার মতো সমস্যা দেখা যায়।
- চোখে সংক্রমণ: কনজাংটিভাইটিসের প্রকোপে চোখের নানা সমস্যার মধ্যে একটি হল দৃষ্টি ঝাপসা হওয়া। তবে শুধু এতেই থেমে থাকে না, চোখের অস্বস্তি ক্রমশ বাড়তে থাকা আর প্রায় কালো দেখার মতো উপসর্গও দেখা দেয় এই রোগে। এই ক্ষেত্রে ঠিক চিকিৎসার মাধ্যমেই দৃষ্টিশক্তিকে ভাল রাখা যেতে পারে।
মনে রাখবেন
- অনেক সময় বাচ্চারা বুঝতে পারে না তাদের চোখে কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না। ঝাপসা দেখলেও তা বড়দের বুঝিয়ে বলতে পারে না। তাই নিয়মিত ভাবে শিশুদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। সন্তান স্কুলে বোর্ড পরিষ্কার দেখতে পায় কিনা, মাঝেমাঝে জিজ্ঞেস করবেন। এর থেকেও কিন্তু চোখের সমস্যা থাকলে তা ধরতে পারবেন।
- হঠাৎ ঝাপসা দেখার নেপথ্যেও থাকে বহু রোগ। তাই চিকিৎসকদের পরামর্শ, ঝাপসা দেখাকে উপেক্ষা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যিক। না হলে বড় ধরনের ক্ষতিও হয়ে যেতে পারে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)