Self Love

অন্যের চোখে গ্রহণযোগ্যতা নয়, নিজের মাধ্যমেই যত্নের প্রকাশ হোক

মধ্যবিত্ত মনে সৌন্দর্যের এক ধরনের ছবি থাকে। তা যখন খাপে খাপে মেলে না, তখনই বাধে গোলমাল। মনের কষ্ট সামলে চলার শুরু তখন থেকেই। কিন্তু, সে সব সামলে নিজেকে ভাল রাখতে পারেন ক’জন?

Advertisement

অন্বেষা বন্দ্যোপাধ্যায় (মনস্তত্ত্বের শিক্ষক)

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৪ ০৬:৪৬
Share:

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

প্রচলিত কথা আছে, কারও সৌন্দর্যই প্রথম আকর্ষণের কারণ, তার পরে বিচার হয় গুণের। তাই স্কুল থেকে কর্মজীবনের পর্বে এসেও শরীরের গঠন বা চেহারা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়নি, এমন মানুষ বিরল। এ সবের জন্য অনেকটাই দায়ভার আমাদের মনের। মধ্যবিত্ত মনে সৌন্দর্যের এক ধরনের ছবি থাকে। তা যখন খাপে খাপে মেলে না, তখনই বাধে গোলমাল। মনের কষ্ট সামলে চলার শুরু তখন থেকেই। কিন্তু, সে সব সামলে নিজেকে ভাল রাখতে পারেন ক’জন? অথচ, তা পারার জন্যই উৎসর্গ করা হয়েছে একটা গোটা দিন। আগামী ২৪ জুলাই ‘ইন্টারন্যাশনাল সেল্ফ কেয়ার ডে’। ওই দিন নিজেরাই নিজের যত্ন নিতে পারার শপথ করার দিন।

Advertisement

এমন খাপে খাপ না মেলারই একটি চরিত্র তিয়াসা। ছোট থেকেই গোলগাল তিয়াসা এক সময়ে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। মোটাসোটা বাচ্চাকে তার অনুমতি না নিয়েই আদর করা যেন অলিখিত অধিকার। এমন ভালবাসা এক কালে বিস্তর পেয়েছে তিয়াসা। কিন্তু তার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন শরীরের গড়নও বদলাতে থাকে, গোলমাল শুরু হয় তখন থেকেই। ইতিমধ্যেই হাতি, জলহস্তী এমন উপাধিও তার কপালে জোটে। সাময়িক খারাপ লাগলেও, শিক্ষিকার বকুনিতে তা মনে চেপে বসেনি। কিন্তু তার যন্ত্রণা প্রকট হয় বয়ঃসন্ধিতে।

ছোটবেলায় যে আত্মীয়েরা তাকে আদর করে কাছে টানতেন, এখন তাঁরাই আঘাত করেন। বাড়িতে ঢুকেই তাঁদের অনেকের কাছে তিয়াসার শরীরটাই আলোচ্য বিষয়। যন্ত্রণায় ভুগতে থাকা তিয়াসা ওজন কমাতে খাওয়া কমায়। কিন্তু, খাবারের সঙ্গে মানুষ এবং পৃথিবীর সমস্ত জীবেরই অদ্ভুত সংযোগ রয়েছে। জন্মানোর পরেই যেটির সঙ্গে মানুষের প্রথম যোগসূত্র তৈরি হয়, তা হল খাবার। অনেকেই অবশ্য বলবেন, প্রথম যোগসূত্র তৈরি হয় ‘মা’-এর সঙ্গে। কিন্তু, মা তো আসছেন খাবারের মাধ্যমেই এবং আমাদের তৃপ্তির বড় অংশ জুড়ে রয়েছে খাবার। অথচ খেলেই আরও মোটা হব, এই ভাবনা থেকে অতৃপ্তি তৈরি হয়। সেই অতৃপ্তি মেটাতে আবার খাওয়ার তাড়না জন্ম নেয়। মোটা হওয়ার আতঙ্কে অনেকে খাওয়া প্রায় ছেড়েই দেন, যা একটি মানসিক অসুখ। উপোস করে ওজন কমানোর দীর্ঘ চেষ্টায় মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

Advertisement

আবার বিপণনের যে দুনিয়ায় আমরা আটকে রয়েছি, তাতে অনলাইন খাবার সরবরাহকারী
সংস্থার হাতছানি এড়িয়ে চলা মুশকিল। যে খাবারের কথা ভেবে উত্তেজনা বোধ করছেন, বেশির ভাগ সময়েই হয়তো তা চোখের খিদে, পেটের নয়। মনে পড়ছে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের
একটি গল্প। বেশির ভাগ সময়ে দেখা যায়, স্তনদুগ্ধ কম পান করেন যাঁরা, ঝাল-মশলাদার খাবার তাঁদের বেশি আকর্ষণ করে। যখন অপরাধী মন শাস্তি দেওয়া শুরু করে, সমস্যা তৈরি হয় তখনই। বহু ক্ষেত্রে তখন খাবার আর উপভোগ্য হয় না। এই যান্ত্রিক যুগে ক্যালরি মাপা যায় সেকেন্ডে। মুহূর্তে উপভোগ করে খাওয়া খাবার পাপবোধের জন্ম দেয়। তখন বেশি খেয়ে বমি করার প্রবণতাও দিতে পারে। এটিও এক ধরনের মানসিক অসুখ। আসলে এর যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে মনের গভীরেই।

একটি বিষয় জানিয়ে রাখা ভাল। মনস্তাত্ত্বিক ডেভিড এলকিন্ড বয়ঃসন্ধিতে ইম্যাজিনারি অডিয়েন্স নামক একটি মানসিক অবস্থানের কথা বলেছেন। যার মানে হল, এই বয়সে ছেলেমেয়েদের মনে কাল্পনিক দর্শক তৈরি হয়, যারা সব সময়ে তাদের লক্ষ করে। তাই এই বয়সে শরীর নিয়ে একটু বেশিই সচেতন হয়ে পড়ে তারা। তবে তাদের ভাবনা একদম উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

সমাজের এঁকে রাখা সৌন্দর্যের বাইরে গেলেই এখন বডি শেমিংয়ের হেনস্থার শিকার হতে হয় অনেককে। এ সব এড়াতে ফিল্টার দেওয়া ছবি ও দাগহীন উজ্জ্বল মুখ ছড়িয়ে পড়ছে ব্যাধির আকারে। শরীর নিয়ে দীর্ঘ যন্ত্রণার মধ্যে হেনস্থার শিকার হননি, এমন মানুষ কোথায়? জরুরি বিষয় হল, এর সঙ্গে মোকাবিলার রাস্তা বার করতে হবে। আসলে এই সব মন্তব্যের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। আমরা ক্রমাগত অন্যের কাছ থেকে গ্রহণযোগ্যতা, ভালোবাসা চেয়ে এসেছি। কিন্তু, সেটা যদি নিজেই নিজেকে দিই, তখন অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হয় না। কোনও বিরূপ মন্তব্যও কষ্ট দেয় না। যেমন, কারও কাছে সৌন্দর্যের চর্চা যদি নিজেকে ভালবাসা বা যত্নের প্রকাশ হয়, তবে তা চালিয়ে যান। কিন্তু, তা যদি নিজেকে
অন্যের চোখে গ্রহণযোগ্য করার প্রচেষ্টা হয়, তবে এক সময়ে বিতৃষ্ণা আসবেই।

তবে, শরীরকে ছাপিয়ে কাজ দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করার উদাহরণ অজস্র। কারণ, বাহ্যিক সৌন্দর্য সাময়িক প্রভাব ফেললেও কাজই আসলে আপনার পরিচয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement