একাকী: করোনা আবহে ঘরবন্দি মানুষ ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন বাইরের জগৎ থেকে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
শুধু ভয়। অন্য কিছু নয়। ভয়ই নিয়ন্ত্রণ করছে প্রত্যেকটা আচরণকে। বাকি অন্য অনুভূতি ভয়ের আবরণে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। কোভিড-১৯ মানুষের স্বাভাবিক আচরণে কী পরিবর্তন এনেছে, তার বিশ্লেষণ করতে বসে এমনটাই দেখতে পেয়েছেন বিহেভিয়োরাল সায়েন্টিস্টরা। তাঁদের মতে, যতক্ষণ জেগে আছেন, ততক্ষণই ‘সংক্রমিত হব না তো’, এই আতঙ্ক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যেখানে মুখ্য হয়ে উঠছে টিকে থাকার তাগিদ। তাই মানুষের আচরণ কোথাও নির্বিকার, কোথাও অশালীন, কোথাও অমানবিক, এমনকি হিংস্রও হয়ে উঠছে।
বিহেভিয়োরাল সায়েন্টিস্টদের একটা বড় অংশের বক্তব্য, কোভিড-১৯ জীবনের প্রতি স্তরেই পরিবর্তন এনেছে। শুধু নির্দিষ্ট অঞ্চলে নয়, বিশ্বব্যাপী সঙ্কট তৈরি করেছে এই অতিমারি। যেখানে শুধু শারীরিক সঙ্কট নয়, মানসিক অস্তিত্বও বিপন্ন। বিশেষত, এখনও পর্যন্ত করোনাকে রোখার কোনও পদ্ধতি না বেরোনোয় তা ভয়ের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যেমন যাদবপুরের বাসিন্দা বছর পঁয়ত্রিশের পর্ণা মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘পুরোপুরি অসামাজিক হয়ে যাচ্ছি। বাইরে বেরোলে বা বাড়িতেও কেউ এলে সব সময়ে টেনশন— এই বুঝি কিছু হয়ে যাবে! সকাল থেকে উঠে শুধু কোন ওষুধ খাব, শরীর খারাপ হলে কোন ডাক্তারকে ফোন করব, কোন হাসপাতালে যাব, এই সব ভেবে চলেছি। এর বাইরে কোনও জীবন নেই।’’
‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর অ্যাপ্লায়েড বিহেভিয়োরাল সায়েন্টিস্ট’-এর পূর্বাঞ্চলের কোঅর্ডিনেটর ক্ষীরোদ পট্টনায়ক বলেন, ‘‘ভয় মানুষকে এমন ভাবে তাড়া করছে যে প্রতিবেশী দূরের কথা, আত্মীয়স্বজনকেও বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছেন না অনেকে। কারও বাড়িতে করোনা আক্রান্ত রয়েছেন শুনলে সেই বাড়ির দিকে মুখ করা দরজা-জানলাও বন্ধ করে রাখছেন। ভয়-ই নিয়ন্ত্রণ করছে প্রত্যেকটা আচরণ!’’
এর অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে। আত্মকেন্দ্রিকতা সীমা ছাড়াচ্ছে। কারও অসুখ হয়েছে শুনলে সাহায্য করা তো দূরস্থান, কী ভাবে তাঁর সঙ্গে অনতিক্রম্য দূরত্ব তৈরি করা যায়, কী ভাবে তাঁকে একঘরে করে দেওয়া যায়— সেই চিন্তাই নিয়ন্ত্রণ করছে অনেককে। শোভাবাজারের বাসিন্দা শুভব্রত দাসের জ্বর হয়েছিল। করোনা পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কী ভাবে যেন রটে যায়, শুভব্রতবাবুর করোনা হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘চেনা মুখগুলোর আচরণই রাতারাতি পাল্টে গেল। সবার মধ্যে এমন একটা ভাব দেখলাম যেন আমার ত্রিসীমানায় আসা তো দূর, আমার সঙ্গে ফোনে কথা বললেও তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়বেন!’’ অথচ, তিন দিন পরে শুভব্রতবাবুর করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট এসেছিল নেগেটিভ।
বিহেভিয়োরাল সায়েন্টিস্ট সোনালি কেলকর বলছেন, ‘‘পরিচিতদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করছেন অনেকে। যাঁদের সঙ্গে দু’দিন আগেও ভাল সম্পর্ক ছিল, তাঁদের সঙ্গেই অনেকে এখন অভব্য আচরণ করছেন। শুধুমাত্র অস্তিত্ব রক্ষাই মুখ্য হয়ে উঠছে এ ক্ষেত্রে।’’
বিহেভিয়োরাল সায়েন্টিস্ট কুমুদ ঈশ্বর আবার জানাচ্ছেন, শুধু ভয় নয়। বিষণ্ণতাও ক্রমশ চেপে বসছে মনের গভীরে। বাইরের জীবনের সঙ্গে অন্দরমহলের জীবনের যে ভারসাম্য ছিল, তা করোনা পরিস্থিতিতে বিঘ্নিত হয়েছে। বাইরের জীবনের গতি হারিয়ে গিয়েছে বদ্ধ ঘরে থেকে। তাই বিষণ্ণতা কাজ করছে। আবার লোকজনের একাংশের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অস্বীকার করার মানসিকতাও কাজ করছে। সেই মানসিকতা থেকে বহু ক্ষেত্রে সচেতনতা-বিধি মানছেন না অনেকে। এন্টালির বাসিন্দা অসীম পাত্র বলছিলেন, ‘‘হলে হবে, কী আর করা যাবে! বাড়িতে তো আর বসে থাকতে পারব না। জীবন যেমন ছিল, তেমনই চলছে।’’
তবে ভয়ের পাশাপাশি এই দুঃসময়ে বাড়ি বাড়ি যাঁরা কাজ করেন, যাঁরা আবর্জনা সাফ করেন, তাঁদের শ্রমের মূল্য নতুন ভাবে বুঝতে পারা গিয়েছে বলে জানালেন ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস’-এর ‘সেন্টার ফর স্টাডি অব সোশ্যাল এক্সক্লুশন অ্যান্ড ইনক্লুসিভ পলিসি’-র অধ্যাপক আভাত্তি রামাইয়া। তিনি বলেন, ‘‘সকলে নন ঠিকই, কিন্তু সংখ্যায় কম হলেও কেউ কেউ বুঝতে পেরেছেন সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো আমাদের জীবনে কতটা অপরিহার্য। করোনা-উত্তর জীবনে এই উপলব্ধিটুকু যদি অটুট থাকে, তা হলে এত অন্ধকারের মধ্যে সেটাই বড় পাওয়া।’’