Toxic Relationship

বিষাক্ত সম্পর্কের বেড়াজাল

শুধু দাম্পত্য নয়, মা-বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গেও সম্পর্ক বিষিয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে কী করবেন? রইল বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

Advertisement

সুনীতা কোলে

শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:০২
Share:

Sourced by the ABP

বাবা-মা, জীবনসঙ্গী, সন্তান, বৃহত্তর পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী — রোজকার জীবনে একটা বড় অংশ জুড়ে থাকেন এঁদের অনেকে। এই সব সম্পর্কের সুতো জড়িয়ে রেখেছে আমাদের। কিন্তু সম্পর্কের মাধুর্য হারিয়ে গেলে? তার বদলে যদি জন্ম নেয় অবিশ্বাস, অবহেলা, তিক্ততা? কখনই বা বুঝবেন যে বিষিয়ে যাচ্ছে সম্পর্ক? টক্সিক সম্পর্ক আর অ্যাবিউজ়ের তফাতই বা কোথায়?

Advertisement

টক্সিক সম্পর্কের চিহ্ন

মনোবিদেরা বলছেন, বেশির ভাগ সম্পর্কে টানাপড়েন থাকেই। তবে পারস্পরিক সম্মান থাকলে সেই ওঠানামা সহ্য করেও বেঁচে যায় সম্পর্ক। কিন্তু দীর্ঘ দিন কোনও সম্পর্কের জেরে অতিরিক্ত খারাপ লাগা, হীনম্মন্যতার মতো আবেগের সামনাসামনি হতে থাকলে সতর্ক হতে হবে তখনই। মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বলছেন, “সম্পর্ক বিষিয়ে যাওয়ার প্রথম চিহ্ন হল ব্যক্তিমর্যাদার দমন। ক্রমাগত অন্য পক্ষের কাছ থেকে তুমি কিছু বোঝো না, ভাবতে জানো না— এমন কিছু শোনা, ব্যক্তিগত মতামতের মূল্য না থাকা, মানুষ হিসেবে গুরুত্ব না থাকা হল ব্যক্তিমর্যাদা দমনের কিছু লক্ষণ।”কেউ ক্রমাগত এমন আচরণ করার পরেও যদি তাঁর মধ্যে পরিবর্তনের কোনও চিহ্ন না দেখা যায়, যদি ক্ষমা চাওয়ার পরেও একই ব্যবহার বারবার করতে থাকেন, তা হলে বুঝতে হবে বিষিয়ে গিয়েছে সে সম্পর্ক। তা থেকে বেরিয়ে আসাই তখন শ্রেয়। অন্যথায় মানসিক অশান্তি চরমে উঠে অবসাদ, বেঁচে থাকার ইচ্ছে চলে যাওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছে যেতে পারেন। তাকে ‘সিভিয়র ইমোশনাল অ্যাবিউজ়’ বলে চিহ্নিত করছেন ডা. রাম।

Advertisement

বিভিন্ন সম্পর্কে তিক্ততা

টক্সিক সম্পর্ক বলতে অনেকেই মূলত জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্ককে বোঝেন। কিন্তু যে কোনও সম্পর্কই বিষিয়ে যেতে পারে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তান, ভাই-বোন, বন্ধু, কাজের জায়গায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা সহকর্মীর সঙ্গেও সম্পর্ক বাঁক নিতে পারে খারাপ দিকে।

  • জীবনসঙ্গী: জীবনসঙ্গীর মধ্যে টক্সিক আচরণের সূত্রপাত মূলত স্বার্থপরতা থেকে হয় বলে জানাচ্ছেন রিলেশনশিপ কাউন্সেলর দেবলীনা ঘোষ। নিজের ইচ্ছে পূরণ করে অন্য জনের ইচ্ছে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এই আচরণের গোড়ায় রয়েছে ছোটবেলায় অবদমন করার ইচ্ছে। বড় হয়ে নিজের ইচ্ছেপূরণ করতে গিয়ে এক জন হয়ে উঠতে পারেন টক্সিক। এ ছাড়া রয়েছে জেন্ডার বায়াস বা লিঙ্গ পক্ষপাত। মহিলাদের উপরে চাপানো হতে পারে নানা বিধিনিষেধ। আবার উল্টো দিকে, কেউ পুরুষ বলে তাঁকে কিছু নির্দিষ্ট জিনিস করতেই হবে, দেখা যায় এমন মনোভাবও। দেবলীনার পরামর্শ, “দুই সঙ্গী যে আসলে একটা দল, সেটা বোঝাই টক্সিসিটি কাটিয়ে ওঠার প্রথম ধাপ। বুঝতে হবে, তাঁরা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামছেন না, বরং একে অপরের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন। প্রয়োজনে ফ্যামিলি থেরাপির শরণাপন্ন হতে পারেন।”
  • বাবা-মা ও সন্তান: সন্তানের উপরে নিজের ইচ্ছে চাপিয়ে দেওয়া, অন্যের সন্তানের সঙ্গে তুলনা, ব্যক্তিগত পরিসর না দেওয়া খুব পরিচিত তিক্ত আচরণের লক্ষণ। সন্তানকে পালন করা বাবা-মায়ের দায়িত্ব। বারবার তা বলে সন্তানের উপরে চাপ সৃষ্টি করা ঠিক নয়। দু’তরফেই মত না মানার ফলে তৈরি হতে পারে ভুল বোঝাবুঝি, দূরত্ব। পরে সন্তান বড় হলে তা অনেক সময়েই প্রভাব ফেলে অন্য সম্পর্কে। আবার প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের তরফে মা-বাবাকে মারধর, সম্পত্তির জন্য চাপ সৃষ্টি করাও হতে পারে টক্সিক সম্পর্কের উদাহরণ। এ ক্ষেত্রে পরিবারের ঘনিষ্ঠ কারও মধ্যস্থতা নেওয়া যেতে পারে বলে জানাচ্ছেন দেবলীনা।
  • কর্মক্ষেত্র: কর্মক্ষেত্রে বিষাক্ত আচরণ দেখলে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। আগে বুঝতে হবে তিনি ব্যক্তিগত কারণে এমন আচরণ করছেন নাকি সমস্যাটা কাজ সংক্রান্ত। কাজ সংক্রান্ত হলে তার সমাধান করা তুলনামূলক ভাবে সোজা। আলোচনার মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে সমাধানের পথ। কিন্তু ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের উপরে ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হলে, সমাধান হওয়া কঠিন। এ ক্ষেত্রে অনেক সময়ে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয় না। তখন চাকরি বদলের সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে।

তিক্ত সম্পর্কের প্রভাব

এমন সম্পর্কের প্রভাবে অবসাদ থেকে শুরু করে কাজের ইচ্ছে হারিয়ে ফেলা, খিদে না পাওয়া, ঘুম কম হওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। অল্পেই মেজাজ হারাতে পারেন বা খিটখিটে হয়ে যেতে পারেন। একটি সম্পর্কের অবিশ্বাস, ভরসাহীনতার প্রভাব গিয়ে পড়ে অন্যান্য সম্পর্কের উপরেও। কেউ যদি আগে থেকেই অবসাদে ভোগেন, তাঁর উপরে প্রভাব পড়ে বেশি। দুর্বল বা শোকগ্রস্ত সময়ে খারাপ আচরণ বুঝতে পারলেও অনেক সময়ে তার প্রতিবাদ করা সম্ভব হয় না, উল্টে সেই মানুষটির উপরেই অতি-নির্ভরশীল হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

কী করণীয়

দেবলীনা ঘোষের পরামর্শ, প্রথমেই তৈরি করতে হবে একটা সীমারেখা। কেমন আচরণ আপনি মেনে নেবেন না, তা স্পষ্ট করে দিন প্রথমেই। পারস্পরিক আচরণে বজায় থাকুক শালীনতা। কোনও কাজ করার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপ এলেও নিজের অবস্থান ধরে রাখতে হবে। মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, একটি বিষাক্ত সম্পর্কের জেরে আশপাশের অন্য সম্পর্কগুলো গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। কিন্তু সেই ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। চিনে নিতে হবে নিজের হিতাকাঙ্ক্ষীদের। চারপাশে তৈরি করতে হবে তাঁদের সুরক্ষাবলয়। তিক্ত সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসাই নিজেকে বাঁচানোর সেরা পথ। কিন্তু সেই কাজও সোজা নয়। বিশেষত পরিবারের মধ্যে এমনটা হলে তা কঠিনতর হয়ে দাঁড়ায়। জয়রঞ্জনের পরামর্শ, “টক্সিক আচরণ যিনি করছেন, তিনি যে বারবার তেমনটা করতেই থাকবেন, সেটা বুঝতে হবে। এর পরে তাঁর উপরে মানসিক নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। যতটা সম্ভব কমিয়ে দিতে হবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ, কথা বলা।”

অন্যদের কাছ থেকে উদার ব্যবহার পাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে আমাদের সকলেরই। কিন্তু ক্রমশ তা কমছে বলে মত দেবলীনার। সেই উদারতার অভাবই গোটা সমাজকে ঠেলে দিচ্ছে পারস্পরিক তিক্ত আচরণের দিকে। তাঁর পরামর্শ, সমাধানের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে শুধু সহমর্মিতা ও উদারতার মাধ্যমেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement