বায়োফ্লক হচ্ছে কম জায়গার মধ্যে বেশি মাছ উৎপাদনের এক নতুন ফিশ কালচার টেকনোলজি। মাছের আধার বলতে আমরা স্বাভাবিক ভাবেই পুকুর, নদীনালা বুঝি। কিন্তু মাছ চাষের এই কৃত্রিম পদ্ধতিতে মাছের উৎপাদন সম্ভব চৌবাচ্চায় বা বড় কন্টেনারে। জেনে নেওয়া যাক সেই পদ্ধতি...
কোথায় এবং কী ভাবে মাছ চাষ করা হয়?
এই পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য সিমেন্টের বা পলিথিনের চৌবাচ্চা প্রয়োজন। অথবা লোহার খাঁচা তৈরি করে, তার মধ্যে প্লাস্টিক জড়িয়ে, জল দিয়ে ভর্তি করেও মাছ চাষ করা হয়। এই ধরনের চৌবাচ্চার আকৃতি সাধারণত গোল হয়। এতে চব্বিশ ঘণ্টা অ্যারেশন ব্যবস্থা রাখতে হবে, অর্থাৎ তাতে যেন বাতাস চলাচল করতে পারে। ফলে সব সময়ে জলে অক্সিজেন যুক্ত হতে থাকে। তাই ইলেকট্রিসিটির বন্দোবস্তও চাই সব সময়ের জন্য।
অল্প জায়গায় যেহেতু অনেক মাছ থাকে, তাই প্রচুর পরিমাণ অক্সিজেনের জোগান দরকার। জল যেহেতু বদলানো হয় না, তাই মাছ ওখানে খায় এবং ওই জলেই মলত্যাগ করে। মাছ কিন্তু মল-মূত্র একসঙ্গে ত্যাগ করে। উচ্চতর প্রাণীদের ইউরিনের সঙ্গে ইউরিয়া নির্গত হয়। মাছ যখন মল-মূত্র একসঙ্গে ত্যাগ করে, তখন তাতে থাকে অ্যামোনিয়া, যা ইউরিয়ার চেয়ে বেশি টক্সিক। অল্প জলের মধ্যে ওই অ্যামোনিয়া মিশে জলটাকে আরও বিষাক্ত করে তোলে।
বায়োফ্লক সিস্টেমে এই অ্যামোনিয়া দূর করা হয় বৈজ্ঞানিক উপায়ে। তার জন্য জলে কার্বন মেশানো হয়। কার্বনের উৎস হিসেবে জলে গুড় বা চালের গুঁড়ো কিংবা ময়দা যোগ করা হয়। এই কার্বন অ্যামোনিয়ার মধ্যে থাকা নাইট্রোজেনকে অপসারিত করে। কার্বন আর নাইট্রোজেন যুক্ত হয়ে একটি যৌগ তৈরি হয় এবং কার্বন যুক্ত হওয়ার ফলে অ্যামোনিয়ার টক্সিসিটি নষ্ট হয়ে যায়।
কী ভাবে ওয়াটার বডি তৈরি করা হবে?
বায়োফ্লক সিস্টেমে যে ওয়াটার বডি বা জলাধার বানানো হয়, তাতে প্রথমে চিটে গুড়, প্রোবায়োটিক আর নুন যোগ করা হয়। দশ হাজার লিটারের ট্যাঙ্কে ৫০০ গ্রাম নুন, ৫০০ গ্রাম চিটে গুড় আর ২০০-২৫০ গ্রাম প্রোবায়োটিক মেশানো হয়। নুন দেওয়া হয় জলের ক্ষতিকারক পরজীবী ধ্বংস করার জন্য, চিটে গুড় যোগ করা হয় কার্বনের উৎস হিসেবে আর প্রোবায়োটিক দেওয়া হয়, কারণ এর মধ্যে কিছু ব্যাকটিরিয়া ডরম্যান্ট কন্ডিশনে বা সুপ্ত অবস্থায় থাকে, জলের সংস্পর্শে এসে তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এই সব ব্যাকটিরিয়া জলের মধ্যে অ্যামোনিয়া দূর করতে সাহায্য করে। মাছের ওয়েস্ট মেটিরিয়ালকে ডিকম্পোজ় করে একটা ফ্লক তৈরি করে। অর্থাৎ জলের উপরে একটা সর তৈরি হয়। এই সরটাই হচ্ছে মাছের খাবার। এই পদ্ধতিতে জল বদলানো হয় না, মাছকে আর্টিফিশিয়াল ফিড দেওয়া হয়, বর্জ্যও জলেই থেকে যায়। এই বর্জ্যই রিসাইকল হয়ে মাছের খাবারে রূপান্তরিত হয়। তাই আর্টিফিশিয়াল ফিডও এ ক্ষেত্রে খুব কম লাগে।
বায়োফ্লক সিস্টেমে খেয়াল রাখা জরুরি অ্যামোনিয়া, ডিজ়লভ অক্সিজেন বা টিডিএস অর্থাৎ ঘনত্বের দিকে। এ ক্ষেত্রে জলের ঘনত্ব ধীরে ধীরে বাড়ে। মাছ যত বড় হবে, তত বেশি খাবে এবং বর্জ্যও বেশি ত্যাগ করবে। ফলে জলের ঘনত্ব বেড়ে যায়। বায়োফ্লক সিস্টেম যদি ঠিক থাকে, কার্বন আর নাইট্রোজেনের অনুপাত যদি যথাযথ থাকে এবং পুরো বর্জ্য যদি খাবারে পরিবর্তিত হয়, তা হলে জলের ঘনত্ব বাড়ে না। এই প্যারামিটার পর্যবেক্ষণ করার জন্য যে ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহার করা হয়, তা খুব সেন্সিটিভ হওয়া জরুরি। অ্যামোনিয়া মাপা হয় যে টেস্টিং
কিট দিয়ে, তা কোনও কারণে খারাপ হলে জলে কতটা অ্যামোনিয়া আছে, তা বোঝা যাবে না। অ্যামোনিয়ার ঘনত্ব বেড়ে গেলে মাছ মরে যাবে। ফলে প্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যাবে না।
ইতিবাচক দিক
এই পদ্ধতিতে অল্প জায়গায় অনেক মাছ উৎপাদন করা যায়। বাড়ির মধ্যে ছোট জায়গায় বা ছাদেও এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা সম্ভব। যে সব মাছের বৃদ্ধির হার খুব বেশি, সে সব মাছ বায়োফ্লকে চাষ করা উচিত। ভিয়েতনামিজ় কই, মোনোসেক্স তেলাপিয়া— এ ধরনের মাছ চাষ করলে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মোনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের চারাকে ফিডের সঙ্গে এক ধরনের হরমোন খাওয়ানো হয়। এটি মেল হরমোন। ২১ দিন যদি ওই হরমোন খাওয়ানো হয়, তা হলে ওই মাছগুলো পুরুষ মাছে রূপান্তরিত হবে। পুরুষ মাছের বৃদ্ধির হার খুব বেশি। যে সময়ে স্ত্রী মাছ ২০০ গ্রাম হবে, ওই সময়ে পুরুষ মাছ ৪০০ গ্রাম হয়ে যাবে। এর সঙ্গে কিছু দামি মাছ, যেমন, দেশি মাগুর, শিঙি, ট্যাংরা, পাবদাও বায়োফ্লক সিস্টেমে চাষ করা যায়। তবে তার বৃদ্ধির হার খুব মন্থর। মাগুর মাছ চাষ করে একবার ফসল তুলতে গেলে আট থেকে দশ মাস সময় দিতে হবে। অন্য দিকে ভিয়েত কই বা মোনোসেক্স তেলাপিয়া তিন থেকে চার মাসে একটা ক্রপ পাওয়া যাবে।
বাড়িতে বায়োফ্লক করতে গেলে কী ভাবে করা যাবে?
প্রথমেই চৌবাচ্চা বানাতে হবে, তা সিমেন্টের হতে পারে বা পলিল্যামিনেটেডও হতে পারে। অন্তত দুটো চৌবাচ্চা বানাতেই হবে। কারণ সব মাছের বৃদ্ধি সমান ভাবে হয় না। ভিয়েত কই চাষ করলে চার মাস পর দেখা যাবে, অর্ধেক মাছ বিক্রিযোগ্য এবং অর্ধেক মাছের সাইজ় ছোট। তখন ওই মাছ দ্বিতীয় চেম্বারে রাখতে হবে। দু’-তিন মাস পরে ওই মাছ বিক্রি করা যাবে। জল তো থাকছেই, সেই সঙ্গে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। ইনভার্টার বা জেনারেটরের ব্যবস্থাও রাখতে হবে। অ্যারেশন প্রক্রিয়ার জন্য ছোট ছোট এয়ার পাম্প প্রয়োজন। ওয়াটার প্যারামিটার চেক করার জন্য আপনাকে কিট কিনতে হবে। এর সঙ্গে মাছের চারা, মাছের খাবার এগুলোও দরকার হবে।
কী কী সমস্যা হতে পারে?
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব পঞ্চায়েত অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্টের অন্তর্গত তমলুক প্রকল্পের ডেপুটি প্রজেক্ট অফিসার ড. উত্তম লাহা বললেন, ‘‘প্রথমে ডেনসিটি কম দিয়ে চাষ করা উচিত। ধরুন, দশ হাজার লিটারের ট্যাঙ্ক বানিয়েছেন, প্রতি হাজার লিটারে যদি ৫০০ করে মাছ ছাড়েন, তা হলে দশ হাজার লিটারে ৫০০০ মাছ ছাড়া যেতে পারে। আমার পরামর্শ, প্রথমেই এত সংখ্যক মাছ ছাড়বেন না। ঘনত্ব বেশি হলে অক্সিজেনের সমস্যা হতে পারে। অ্যামোনিয়া কোনও কারণে বেড়ে গেলে মাছ মরে যেতে পারে। আবার ঘনত্বের কারণে মাছের রোগও হতে পারে। তাই বলব, প্রথমেই এক হাজার মাছ ছেড়ে একবার শস্য তুলুন। তাতে আপনারও একটা ধারণা হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে ঘনত্ব বাড়াবেন। তাতে সমস্যা কম হবে।’’ সেই সঙ্গে মাছের জন্য এমন খাবার কিনতে হবে, যা সহজে জলে গলে যায় না, যার ওয়াটার স্টেবিলিটি বেশি। ফলে অনেকক্ষণ ধরে মাছ খেতে পারবে, খাবার নষ্ট হবে না।
যে কোনও চাষই মাটির উপরে করা গেলে বেশি কার্যকর হয়। এ ক্ষেত্রে তা পুকুরে করলে উৎপাদন খরচ অনেক কম হবে। তাই বায়োফ্লক শুরু করার আগে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় এ ভাবে মাছের চাষ খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। বিদেশে জ্যান্ত মাছ বেশি দামেও বিক্রি হয়। কিন্তু আমাদের এখানে যেহেতু মাছের উৎপাদন প্রচুর, তাই বায়োফ্লক সিস্টেমে মাছ চাষ এমন ভাবে করতে হবে, যাতে সেই মাছের দাম বাজারের তুলনায় বেশি না হয়। দাম বেশি হলে বিক্রি করা মুশকিল হবে। তাই উৎপাদন খরচ বাড়লে লাভবান হওয়া কঠিন।
এ ক্ষেত্রে কোন মাছ চাষ করবেন, তা নির্ণয় করাটা সবচেয়ে জরুরি। যে মাছের চারা ছাড়বেন, সেটা যেন প্রাথমিক অবস্থায় একটু বড় হয় এবং তার রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা, লড়াই করার ক্ষমতা বেশি থাকে। সেই কারণে ভিয়েত কই ও মোনোসেক্স তেলাপিয়ার চাষ বেশি হয়। এই দিকগুলো মাথায় রেখে মাছ চাষ করা হলে, তা অবশ্যই রোজগারের নতুন পথ খুলে দেবে।
তথ্য: WBCADC, তমলুক প্রজেক্ট, ডিপার্টমেন্ট অব পঞ্চায়েত অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট, পশ্চিমবঙ্গ সরকার