মুখ ঢেকেছে বিজ্ঞাপনের। দক্ষিণ কলকাতায়। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
অতিমারিতে ফোটোশপের কদর বাড়ে! নন্দন-রবীন্দ্র সদন থেকে সল্টলেকের রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবন, টালিগঞ্জের চলচ্চিত্র শতবর্ষ ভবন, সর্বত্রই এখন মুখে মাস্ক সেঁটে বাইকে সওয়ার সপ্তপদীর কৃষ্ণেন্দু-রিনা ব্রাউন। তোপসে-ফেলুদার মুখেও মাস্ক। ‘টাইটানিক’ ছবির জ্যাক আর রোজ় থেকে ‘ব্যাটম্যান’-এর জোকার, মায় হ্যারি পটার সকলেই মাস্কের আড়ালে।
ফোটো-এডিটিং এ বার তা হলে বেড়েছে বলুন? জিজ্ঞাসা করেছিলাম উৎসবের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হরনাথ চক্রবর্তীকে। তিনি হেসে ফেললেন, ‘‘হ্যাঁ, ওটার আসল উদ্দেশ্য ছিল জনসচেতনতা বাড়ানো। সবাই ছবি দেখতে এসে যাতে মাস্ক পরেন, সেটা মনে করিয়ে দেওয়া আর কী!’’ ফোটোশপ ছাড়া বাস্তব মাস্কও আছে। কমিটির সদস্য থেকে উৎসব-কর্মী, সকলের মুখেই শোভা পাচ্ছে ‘কিফ ২৬’ লেখা নীল-সাদা মাস্ক।
এর বাইরে কাগজ ও ছাপা বাবদ স্টেশনারির খরচ কমেছে। প্রতি বার উৎসবের খবরাখবর নিয়ে রোজ চার পাতার বুলেটিন থাকে, এ বার তা কমে দুই পাতার। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বোধন করা ব্রোশিওরটি বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়, এ বার তা মাত্র ১৯০ পাতার। দেশি-বিদেশি অতিথির ভিড় নেই, ফলে হোটেল ও গাড়ি-খরচ কমেছে। ‘‘গত বারের উৎসবের পরে যথারীতি জানুয়ারি এবং মার্চ মাসে আমাদের বৈঠক হয়েছিল। তার পরে ২২ মার্চ থেকে আচমকা লকডাউন। পরে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আমরা তিন রকম রাস্তাই খোলা রেখেছিলাম। করোনা বাড়লে উৎসব হবে না। যদি ঠিকঠাক থাকে, নভেম্বরে যেমন হওয়ার, হবে। নইলে একটু পিছিয়ে সীমিত দর্শক নিয়ে মধ্যপন্থা,’’ জানালেন হরনাথ।
করোনার আতঙ্ক এড়িয়ে, সীমিত উপস্থিতির এই উৎসবে কলকাতার বরং কিঞ্চিত লাভ হল। আজ, বুধবার বিকেলে সল্টলেকের রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে ফিলিপিন্সের পরিচালক লাভ দিয়াজের নতুন ছবি জেনাস প্যান। এই ছবির জন্যই এ বারের ভেনিস উৎসবে সেরা পরিচালকের সম্মানে ভূষিত তিনি। ১৪ জানুয়ারি সকালে নন্দনে সম্প্রতি বার্লিনে সেরা ছবি হিসেবে পুরস্কৃত ইরানের ‘দেয়ার ইজ নো ইভিল’, কান চলচ্চিত্র উৎসবে বহুল প্রশংসিত ফ্রান্সের ‘সামার অব এইট্টিফাইভ’ও এ বার দেখা যাবে নন্দনে।
ঘটনাচক্রে ২০২০ সালে বার্লিন ছাড়া কোনও উৎসবই পুরোদস্তুর হয়নি। ভাইরাসের ভয়ে দর্শকশূন্য হল, জুরি সদস্যেরা বাড়িতে ছবি দেখে, নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। কলকাতা সেখানে ব্যতিক্রমী সাহস দেখিয়েছে। সব আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবকে যে আন্তর্জাতিক নিয়ামক-সংস্থা ফিয়াপ (ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন)-এর নির্দেশনামা মেনে চলতে হয়, সেই সংস্থাও এ বার কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবকে ফিজ়িক্যাল স্ক্রিনিং-এর জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছে, ‘সিনেমার বেঁচে থাকার জন্যই উৎসবের দৃশ্যমানতা জরুরি।’
ইউরোপে এতগুলি ফেস্টিভ্যাল ঠিকঠাক হল না বলেই কি এ বার কলকাতায় ভাল ছবির দৃশ্যমানতা আর একটু বাড়ল? ছবি বাছাই কমিটির সদস্য, পরিচালক শেখর দাশের কথায়, ‘‘আমরা বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে ছবি আনাই। এজেন্সি আবার কোন উৎসবে ছবি দিতে আগ্রহী হবে, সেটা নির্ভর করে ফেস্টিভ্যালের রেটিং-এর উপরে। এত বেশি দর্শক আসার কারণে ফিয়াপ আগেই আমাদের রেটিং বাড়িয়েছিল। আর প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বিভাগে এখন গোয়া ৫০ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেয়, আমরা ৫১ লক্ষ। ফলে অনেকেই এখানে আসার উ়ৎসাহ দেখাচ্ছেন।’’ তার চেয়েও বড় কথা অন্যত্র। ‘‘গোয়া এ বার শুধু উদ্বোধনী আর সমাপ্তি অনুষ্ঠানে দর্শকদের থাকতে দিচ্ছে, হলে উৎসব দেখানোয় এখনও নারাজ,’’ বললেন হরনাথ। ফলে অ্যাডভান্টেজ কলকাতা!
বাকিরা? অতিমারিতে হায়দরাবাদে এ বার সিনেমা উৎসব হচ্ছে না। কলকাতার মতো কেরলেও সিনেমা-উৎসব ঢের পিছিয়ে ফেব্রুয়ারিতে। তবে সেখানে ২০০ জনের বেশি দর্শককে প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে না। হলে আসার ৪৮ ঘণ্টা আগে করোনা পরীক্ষা করিয়ে নেগেটিভ শংসাপত্র নিয়ে আসতে হবে। কলকাতায় কোভিড পরীক্ষায় ঝামেলা নেই। তবু অভিজ্ঞতা বলছে, ২০০-টাও অনেক বেশি। চল্লিশ-পঞ্চাশ হলেই যথেষ্ট! ডেলিগেট কার্ডের অর্থমূল্যও এ বার কমিয়ে দিচ্ছে কেরল। সেখানে হাজার টাকার বদলে ৭৫০ টাকা। কলকাতায় সেটি দেওয়া হয়েছে বিনামূল্যে।
শুধু বড় পর্দা বনাম মোবাইলের ওটিটি নয়। অতিমারি বদলে দিচ্ছে সারা দেশে ফিল্মোৎসবের ভাষা।