এ দেশে প্রতি দশ হাজার জনসংখ্যা পিছু ২৩ জনের অটিজ়ম। শতাংশের নিরিখে ০.২৩। স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে করা একটি সমীক্ষার ভিত্তিতে এই তথ্য জানাচ্ছেন ইংল্যান্ডের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর অটিজ়ম’-এর রিসার্চ ডিরেক্টর ভীষ্মদেব চক্রবর্তী। তাঁর মতে, শতাংশের হিসেবে এটা সামান্য মনে হলেও ভারতের জনসংখ্যার বিচারে তা বিপুল। অটিজ়ম স্পেকট্রাম ডিজ়অর্ডার আছে যাঁদের, তাঁদের জন্য উপযুক্ত পরিকাঠামো কি আদৌ এ দেশে আছে? আজ, ২ এপ্রিল ‘ওয়ার্ল্ড অটিজ়ম ডে’-তে ফের উঠে আসছে পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব।
শুধু কলকাতাতেই অটিজ়মের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হাতে গোনা কয়েকটি। বনহুগলিতে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত একটি সংস্থা ছাড়া কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। আর আছে অভিভাবকদের ছোট ছোট প্রচেষ্টা। অভিযোগ, এর মধ্যে অধিকাংশই বিত্তবান সমাজের কথা ভেবে তৈরি। ফলে চাহিদা মতো অটিজ়মের প্রশিক্ষণে ফাঁক থেকে যাচ্ছে, মানছেন অনেকেই। যেমন, হুগলির হরিপালের পুষ্পেন্দু সামন্তকে সেখানকার নসিবপুরের একটি স্কুলে প্রশিক্ষণ দেওয়াচ্ছেন পরিজনেরা। করোনার জন্য দু’বছর বন্ধ প্রশিক্ষণ। ওই স্কুলের অধ্যক্ষ গৌতম পাল বলছেন, “প্রতিবন্ধকতাযুক্ত পড়ুয়াদের নিয়ে ধুঁকে স্কুল চলছে। চেষ্টা সত্ত্বেও স্কুল অধিগ্রহণ করেনি সরকার।’’
আবার দমদমের কাজীপাড়ার বাসিন্দা বছর ২৪-এর রিতম দাস বেড়ে ওঠার সঙ্গী হিসাবে পেয়েছেন মা-বাবাকে, সঙ্গে প্রশিক্ষণও। সাত বছর ধরে বনহুগলির ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর দি এমপাওয়ারমেন্ট অব পার্সনস উইথ ইন্টেলেকচুয়াল ডিজ়এবিলিটিজ়’-এ (এনআইইপিআইডি) প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন রিতম। সেন্ট স্টিফেন্স স্কুল থেকে ৫০ শতাংশ নম্বর পেয়ে আইসিএসই পাশ যুবক গান ও আঁকায় যুক্ত।
এনআইইপিআইডি-র কলকাতা আঞ্চলিক শাখার অফিসার-ইন-চার্জ টি মুগেশ বলেন, ‘‘অটিজ়মের জন্য যাঁরা প্রশিক্ষণ নিতে চান, এমন নবাগতদের প্রথমে বিস্তারিত ইতিহাস নেওয়া হয়। অবস্থা বুঝে তাঁদের শিক্ষাগত, মনস্তাত্ত্বিক, চিকিৎসা সংক্রান্ত এবং পূর্ণবয়স্কদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত বৃত্তিমূলক মূল্যায়ন হয়। চিকিৎসক এবং স্পেশ্যাল এডুকেটরের তত্ত্বাবধানে চলে প্রশিক্ষণ।’’ প্রতিষ্ঠানের স্পেশ্যাল এডুকেটর সৌমি বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, সপ্তাহে এক দিন করে প্রতি তিন মাসের মোট খরচ ১০০ টাকা। রেজিস্ট্রেশন-পর্বে দিতে হয় ৪৫০ টাকা। তবে যাঁরা দারিদ্রসীমার নীচে, তাঁদের প্রশিক্ষণ হয় নিখরচায়। রেজিস্ট্রেশনের জন্য তাঁদের দিতে হয় ১৬০ টাকা।’’
অটিজ়ম নিয়ে সরকারের মনোভাবে বিরক্ত ‘অটিজ়ম সোসাইটি, ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এর প্রতিষ্ঠাতা ইন্দ্রাণী বসু। এক জন পড়ুয়া পিছু এক জন শিক্ষক— এই অনুপাতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সেখানে। হতাশ ইন্দ্রাণী বলছেন, “অটিজ়ম নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনাই নেই। আসলে সরকারের তালিকায় ওঁদের মূল্য নেই।’’ অনেকটা একই সুরে ‘প্রদীপ সেন্টার ফর অটিজ়ম ম্যানেজমেন্ট’-এর অধিকর্তা মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “এটা খুবই দুঃখজনক যে, সরকারের এ বিষয়ে ভূমিকাই নেই। আর্থিক টানাপড়েন সত্ত্বেও আমরা চালাচ্ছি। ওঁদের তৈরি বিভিন্ন জিনিস সাজিয়ে আজ থেকে বেলেঘাটায় বিপণি খুলছে আমাদের সংস্থা। সেখানে বসবেন ওঁরাই।’’
স্বাস্থ্য ভবনের এক কর্তা বলছেন, “অটিজ়ম আছে, এমন নাগরিককে শংসাপত্র দিতে বছরখানেক আগে কিছু চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ হয়েছিল। সেই কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হয়নি। তবে কয়েক বছর আগে ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি এবং রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে সরকারি উদ্যোগে অটিজ়মের বিভিন্ন থেরাপির প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল। কিন্তু করোনা-পর্বে তা প্রচার পায়নি।’’
অটিজ়ম নিয়ে গণমাধ্যমে সরকারি প্রচারের কথা বলছেন স্নায়ু-মনোরোগ চিকিৎসক জিষ্ণু ভট্টাচার্য। তাঁর মতে, “অটিজ়ম মাইল্ড হলে স্বাভাবিক স্কুলেই পড়ানো উচিত। শিক্ষকদের খোলা মনের হতে হবে। অপরিচিত পরিবেশে গেলে ধীরেসুস্থে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলুন। অন্য বাচ্চাদেরও সহানুভূতিশীল হতে বলুন। মনে রাখবেন, ওদের বিশেষ ক্ষমতা লুকনো থাকে। সন্তানের থেকে সেটা বার করা আপনার দায়িত্ব।”