ভার্চুয়াল দুনিয়ায় আটকা পড়ে শৈশব। সত্যিকারের বন্ধুর হাত ধরার উপায় কী?
Mobile Phone

Mobile Phone: একসাথে নয়, আসলে যে একা

ভার্চুয়াল দুনিয়ার সুফল-কুফলকে চিনে নিতে হবে। তার মাঝে ব্যালান্সড জীবনযাত্রা বেছে নেওয়াই হতে পারে সুস্থ-সুন্দর ভবিষ্যতের রাস্তা।

Advertisement

সায়নী ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২২ ০৮:১০
Share:

ছবি: শুভদীপ সামন্ত

পৃথিবীটা যে ছোট হতে হতে স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে বন্দি হয়ে যাবে, সে কথা গুণিজনেরা বহু দিন আগেই বলে গিয়েছিলেন। ভার্চুয়াল দুনিয়া কী, তা তাঁরা জানতেন না। না হলে সেই ভবিষ্যদ্বাণীও করে যেতেন হয়তো। মুঠোফোন আর কম্পিউটারে বন্দি হয়ে যাওয়া প্রজন্ম, বদলে যাওয়া চারপাশটার প্রভাব সামাজিক ও মানসিক ভাবে কতখানি সুদূরপ্রসারী হতে পারে, তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। বিশেষ করে কোভিড-পরবর্তী সময়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় অগুনতি বন্ধু, এ দিকে সহপাঠীর জন্মদিনে ‘ভার্চুয়াল বার্থডে পার্টি’তে অংশ নিতে হচ্ছে! জন্মদিনের ‘নেমন্তন্ন’-র খাবার চলে আসছে সুইগি মারফত, করোনা-পরবর্তী যুগে সেই অভিজ্ঞতাও হয়ে গিয়েছে অনেকের। সমস্যা ঠিক কোথায়, সেটা বুঝতে পারলেও অনেকেই ধরতে পারেন না তার থেকে বেরোনোর উপায়।

Advertisement

সমস্যার সূত্রপাত ও গভীরতা

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক সুহৃতা সাহা তাঁর বক্তব্যে ধরতে চাইলেন সমস্যার উৎপত্তির জায়গাটা, ‘‘ভার্চুয়াল জগতের উপরে নির্ভরতা বেড়ে গিয়েছে সব বয়সিদেরই। যে বয়স্ক মানুষটি আগে পাড়ার চায়ের দোকান কিংবা ক্লাবে গিয়ে আড্ডা দিতেন, তিনিও সংক্রমণের ভয়ে বাড়িতে বসে বেশির ভাগ সময়টা স্ক্রিনেই কাটিয়ে দিচ্ছেন। দিনে দিনে আমরা আরও বেশি করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজের দিকে এগিয়ে চলেছি। যে সমাজ ভীষণ ভাবে কনজ়িউমার-ফ্রেন্ডলিও। সেই অনুযায়ী প্রায় সব ইন্ডাস্ট্রিও নিজেদের পন্থা বদলে ফেলেছে। জীবনযাত্রার ধরন বস্তুগত স্বাচ্ছন্দ্যে আটকা পড়ে যাচ্ছে। সমস্যার উৎপত্তিও সেখান থেকেই।’’

Advertisement

আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু, সহকর্মীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ মেলামেশায় যে উষ্ণতা আছে, সম্পর্কগুলির মধ্যেকার যে ওম রয়েছে, সেটা ভিডিয়ো কলে থাকা সম্ভব নয়। অনেকে আবার এই একাকিত্বটাই শ্রেয় বলে মনে করছেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবীর মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘যাঁরা সোশ্যাল অ্যাংজ়াইটিতে ভোগেন, আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে বা কোনও কারণে গুটিয়ে থাকেন, অনলাইন মাধ্যম তাঁদের এই এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতাকে আরও ইন্ধন জোগাচ্ছে। ফলে তাঁরা অজান্তেই আরও একা হয়ে পড়ছেন ও অবসাদ গভীর হচ্ছে।’’

সোশ্যাল মিডিয়া ও গেমিং

প্রফেসর সাহার মতে, ফিজ়িক্যাল স্পেসে ইগো সরিয়ে রেখে অন্যের বক্তব্য বা পছন্দ-অপছন্দ শোনা, তার সঙ্গে মানিয়ে চলার অভ্যেসের দরকার হয়। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় সেই অভ্যেসের সম্পূর্ণ বিপরীতে হেঁটে অসহিষ্ণুতা, সংবেদনশীলতা, ধৈর্যের অভাব, নিজের মন্তব্যকেই শেষ কথা বলে ধরে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। ‘‘এর ফলে একটা সিউডো লিবারলিজ়ম তৈরি হয়েছে, যেটার বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই। নিজেদের সম্পর্কেও ভ্রান্ত ধারণা তৈরি হচ্ছে আমাদের। ‘না’ শুনতে শিখছি না, সমালোচনাও নিতে পারছি না,’’ বললেন তিনি। ব্যক্তিগত আবেগকে ‘পাবলিক’ করে দিচ্ছি আমরা। বডি শেমিংয়ের বিরোধিতা করে নিজেরাই ফোটোশপড ছবি আপলোড করছি। সকলের চোখে নিজেকে ‘প্রেজ়েন্টেবল’ দেখানোর তাগিদ ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে তুলছে।

কোনও ঘরোয়া আড্ডায় বড়দের ঘর থেকে ভেসে আসছে হাসির আওয়াজ। সেখানে বাচ্চাদের ঘরে ঢুকলে দেখা যায় নৈঃশব্দ্য। কারণ, সকলের চোখই মোবাইলের স্ক্রিনে। পাশাপাশি বসে তারা কথা বলছে চ্যাটবক্সে! একই কারণে শিশুদের মধ্য থেকে হারিয়ে গিয়েছে সহজাত বিস্ময়বোধও।

অতএব উপায়?

নিজের প্রতি সৎ থাকা, মধ্যবিত্ততাকে মেনে নেওয়া, অল্পে খুশি থাকা ও আত্মসমালোচনার মতো বিষয়গুলির উপরে জোর দিচ্ছেন অধ্যাপক সাহা, ‘‘প্রতিযোগিতার চাপ থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। জীবনবোধ বা দর্শন যেন হারিয়ে না ফেলি, খেয়াল রাখতে হবে সে দিকে। যাবতীয় খুঁটিনাটি ফেসবুক-ইনস্টায় দেওয়ার আগে ভাবতে হবে, সবটার প্রকাশ্য বিজ্ঞাপন কি আদৌ জরুরি?’’

অন্য দিকে, ডা. মুখোপাধ্যায়ের মতে, যে সমস্যা এক দিনে তৈরি হয়নি, তার সমাধানও রাতারাতি হওয়া সম্ভব নয়। ‘‘অন্যের সঙ্গে যোগস্থাপন করার স্বাভাবিক ন্যারেটিভ যদি ভেঙে যায়, সেখান থেকে একাকিত্ব, অবসাদ এবং ক্রমে আত্মহত্যার প্রবণতা আসতে পারে। স্ক্রিনের আড়ালে অনেক কিছু লুকোনো যায়। মিসকমিউনিকেশনও বাড়ে,’’ বললেন ডা. মুখোপাধ্যায়।

ইন্টারনেট আমাদের সঙ্গেই থাকবে। তার বিপুল সুবিধেও এড়িয়ে যাওয়ার নয়। তবে মোবাইল কেড়ে নিয়ে বই ধরিয়ে দিলেই যদি ভাবেন সমাধান মিলবে, তা হলে ভুল হবে। ডা. মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শ, ‘‘সন্তানকে অ্যাক্টিভিটিতে এনগেজ করুন। স্পোর্টস ক্লাস, অনলাইনের পরিবর্তে ফিজ়িক্যাল টিউশন, কোনও পোষ্যের দায়িত্ব দেওয়া... ইত্যাদি কাজকর্মে শামিল করুন।’’

ভার্চুয়াল দুনিয়ার সুফল-কুফলকে চিনে নিতে হবে। তার মাঝে ব্যালান্সড জীবনযাত্রা বেছে নেওয়াই হতে পারে সুস্থ-সুন্দর ভবিষ্যতের রাস্তা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement