পাল্টে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলা দিন যাপনে বদলে গিয়েছে সম্পর্কে সংজ্ঞাগুলিও। লকডাউন আর ওয়র্ক ফ্রম হোমের দৌলতে ব্যক্তিগত পরিসর কমে গিয়েছে সকলের। সেই সঙ্গে যেমন কোথাও বেড়েছে সংঘাত, কোথাও আবার একসঙ্গে থাকতে থাকতে মজবুত হয়েছে বোঝাপড়া। মুদ্রার দু’পিঠ থাকলেও সমস্যার পাল্লা অনেক ক্ষেত্রেই ভারী। সেগুলি চিনে নেওয়া ও তার থেকে বেরোনোর উপায় খোঁজা জরুরি। কারণ, শেষ পর্যন্ত ভাল থাকাটাই আমাদের লক্ষ্য।
প্রত্যাশা, সমস্যা ও সংঘাত
অতিমারির আবহে দীর্ঘ সময় ধরে বাড়িবন্দি থাকতে থাকতে আশপাশের সম্পর্কগুলিতে যে অনিবার্য সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা চিনে নেওয়া দরকার।
• বাড়ির কাজ এবং বাড়ি বসে বাইরের কাজে তাল মেলাতে না পারা। ওয়র্ক ফ্রম হোমের সৌজন্যে এলোমেলো হয়ে যাওয়া রুটিনে টাইম ম্যানেজমেন্টে হয়েছে ঘাটতি।
• স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজন ওয়র্ক ফ্রম হোম করলে এবং অপরজন না করলে, দ্বিতীয় জনের কাছ থেকে কাজের প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়া। যাঁর ওয়র্ক ফ্রম হোম নেই, তাঁর ব্যক্তিগত অবসরযাপনে বাধাও পড়ছে।
• বাড়ির কর্ত্রী যদি ওয়র্ক ফ্রম হোমে ব্যস্ত থাকেন, সেই সময়েও তাঁর কাছ থেকে বাড়ির অন্য সদস্যদের নানা প্রত্যাশা সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
• মা-বাবা বাড়িতে থেকেও কেন সময় দিচ্ছে না, ছোটদের তা বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। আবার অভিভাবকরা বাড়িতে থাকায় প্রাইভেসির সমস্যা হচ্ছে ইয়ং অ্যাডাল্টদের।
• শাশুড়ি বা মায়ের কাছে সন্তানকে রেখে যিনি কাজে বেরোতেন, তিনি এখন বাড়িতে থাকায় সন্তানের দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া নিয়ে সমস্যা। দাদু-ঠাকুমা ও মা-বাবার অভিভাবকত্বের আলাদা ধরন নিয়েও তৈরি হতে পারে সংঘাত।
কোয়ালিটি টাইম
সকলে মিলে একসঙ্গে থাকা মানেই যে ভাল থাকা, তা সব সময়ে সত্যি নয়। বরং কোয়ালিটি টাইম কাটানো জরুরি বলে মনে করেন মনস্তত্ত্ববিদ রিমা মুখোপাধ্যায়। ‘‘যাঁরা ওয়র্ক ফ্রম হোম করেন, তাঁদের বাড়ির লোক কিংবা ওয়র্কিং পেরেন্টদের সন্তানদেরই যে শুধু সমস্যা হচ্ছে, এমনটা নয়। তা ছাড়া, কাজের জায়গায় তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা, নেশাসক্তি, গার্হস্থ হিংসার মতো অনেক ঘটনাই বেড়ে গিয়েছে গত ছ’মাসে,’’ বললেন রিমা মুখোপাধ্যায়।
বাড়িতে কারও সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলে বাইরে কাজে বেরোনোর পরে সেটা ভুলে থাকার একটা পরিসর ছিল, এখন যেটা নেই। লকডাউনের শুরুতে অনেকে যেমন মনে করেছিলেন যে, একসঙ্গে থাকলেই হয়তো ভাল থাকা যাবে, লকডাউনের পরবর্তী পর্বে সেই চিত্র পাল্টে গিয়েছে অনেক জায়গাতেই। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, তেঁতুলপাতায় ন’জনের সঙ্কুলান করতে গিয়ে সুজনদের মধ্যকার সংঘাত বেড়ে গিয়েছে এই সময়ে। ‘‘বাড়ি থেকে অফিসের কাজের জন্যও একটা পরিবেশ দরকার হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই সাপোর্টিভ অ্যাম্বিয়েন্সের ছবিটা দেখা যাচ্ছে না,’’ বললেন তিনি।
মুদ্রার অপর পিঠ
শুধুই সংঘাত নয়, লকডাউনে শাশুড়ি-বৌমা কিংবা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে, এমন উদাহরণও কম নেই। যাঁরা এত দিন সময়ের অভাবে হয়তো ফ্যামিলি প্ল্যানিং করে উঠতে পারেননি, তাঁরা সে দিকে মন দিয়েছেন, এমন নজিরও কিন্তু আমাদের চারপাশে কম নেই। যে অভিভাবকেরা সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে না পারার গ্লানিতে ভুগতেন, তাঁরা সেই অবকাশ পেয়েছেন। ছোট বাচ্চারাও মা-বাবাকে পেয়ে খুশি।
ভাল থাকার সহজ উপায়
• যাঁরা বাড়িতে থেকে অফিসের কাজ করছেন, তাঁদের বাড়ির বাকিদের সঙ্গে কথা বলে কাজ ও দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে, ঠিক আগের মতোই।
• অফিস আওয়ার্স চলাকালীন আপনাকে ডাকলে না-ও পাওয়া যেতে পারে, তা বুঝতে হবে পরিবারের বাকিদের। বাড়ির বাচ্চাদের ও বয়স্ক সদস্যদের বুঝিয়ে বলতে হবে প্রয়োজনে।
• সারা দিনে নিজের জন্য সময় বার করা জরুরি। যে সময়টুকুতে আর কোনও দায়িত্ব বা কর্তব্যের সঙ্গে সংযোগ থাকবে না। পাশাপাশি বাড়ির ওয়র্কিং মেম্বাররা বেরিয়ে গেলে বাকিরা যেমন করে সময় কাটাতেন নিজেদের মতো, তাঁদেরও সেই পরিসর তৈরি করে দিতে হবে।
অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘অন্যের আমাকে ভাল লাগল কি না, তার চেয়েও প্রাধান্য দেওয়া দরকার আমি ভাল রইলাম কি না, তার উপরে। কাজের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে গিয়ে অন্যের অপ্রিয় হয়ে উঠলেও তা করা জরুরি।’’ বাড়ির বয়স্করা যে সময়ে টেলিভিশনে সিরিয়াল দেখেন, সেই সময়েই বাড়ির কমবয়সিরা ফোন কিংবা ল্যাপটপে আইপিএল দেখতে পারেন— এ ভাবে অ্যাডজাস্ট করার পরামর্শ দিলেন অনুত্তমা। সম্পর্ক সহজ রাখতে দিনের অন্তত একটা সময়ে একসঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া, আড্ডা মারা বা সিনেমা দেখার মতো অবসর বার করে নিন। আর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ২৪ মিনিট হলেও বার করুন নিজের জন্য। নিজেকে ভাল রাখতে।