দিনকতক ধরেই ছাদে খেলতে যাচ্ছে না ছোট্ট মহুল। আগে বিকেল হলেই সে ব্যাট, বল নিয়ে বেরিয়ে পড়ত পাড়ার গলিতে। কিন্তু অতিমারির জেরে রাস্তায় বেরোনো বন্ধ হওয়ায় ছাদে শুরু হয় খেলা। কিন্তু ছাদ থেকে বারবার বল পড়ে যাওয়ার সমস্যা, বড়দের বকুনি। তাই সে আর খেলতেই যায় না।
অন্য দিকে তোয়াও এখন আর বন্ধুদের সঙ্গে সে ভাবে গল্প করে না। দিনের বেশির ভাগ সময় ফোনে মুখ গুঁজেই বসে থাকে।
বড়দের জন্য আনলক শুরু হলেও বাচ্চারা প্রায় ঘরবন্দি। তাঁদের স্কুল, কোচিংও বন্ধ। বেশির ভাগ সময়েই তারা আটকে রয়েছে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই। ক্রমশ তাদের বাইরে যাওয়ার আগ্রহও যেন হারিয়ে যাচ্ছে। বহির্জগতে মেশার ইচ্ছেটাও চলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে তারা ঘরকুনো হয়ে পড়ছে না তো! তাদের স্থাণুবৎ জীবনে একটু তরঙ্গ তোলার কাজটা কিন্তু মা-বাবাকেই শুরু করতে হবে। প্রথমে সন্তানের বয়স হিসেবে ভাগ করে নিন...
পাঁচের নীচে বয়স হলে
• একেবারে কোলের শিশু না হলে, তাদের কিন্তু বোধ তৈরি হয় একটু একটু করে। ওরা কিছু বুঝবে না— এমন ভাববেন না। তিনের বেশি বয়স হলেই সে অল্প অল্প করে সব কিছুই বুঝতে শেখে। এই ধরনের শিশুরা যদি বাইরে বেরোতে না চায়, তা হলে জিজ্ঞেস করুন, সে কেন বাইরে যেতে চায় না। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বললেন, ‘‘অনেক সময়েই অভিভাবকরা সন্তানদের কিছু বারণ করার সময়ে সেটা সম্পর্কে ভয় দেখান। আপনি হয়তো কখনও ওকে ‘করোনাজুজু’ বা ‘দৈত্য’ এ ভাবে বুঝিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে আপনি বুঝতে পারছেন করোনাজুজু বা দৈত্য ব্যাপারটা কী! কিন্তু খুদেটির কাছে সেই ধারণা স্পষ্ট নয়। বরং ওদের মনে ভয় কাজ করে বেশি। তাই ওর মনের ভয় কাটাতে হবে আগে এবং আপনােকই।’’
• সন্তানকে সুরক্ষিত ভাবে বাইরে বার করুন। মুখে মাস্ক পরিয়ে স্যানিটাইজ়ার সঙ্গে নিয়ে মাঝেমাঝে রাস্তা থেকে হেঁটে আসতে পারেন। এমন সময় বেছে নিন, যে সময়ে লোকের যাতায়াত কম থাকে।
• আশপাশের বাড়ির মানুষের সঙ্গে ওকে কথা বলতে দিন। হয়তো জানালা বা বারান্দা থেকেই সে কথা বলল, সেটাও কিন্তু ওর কাছে বহির্জগতের একটা দরজা খুলে দেবে।
পাঁচ থেকে বারোর মধ্যে
• এই বয়সের শিশুর মনোজগতে অনেক পরিবর্তন ঘটে। এ সময়ে কিন্তু ওরা নিজের মতো করে পৃথিবীটা দেখতে শুরু করে। নিজের পছন্দ, অপছন্দ তৈরি হয়। বন্ধু তৈরি হয়। এ সময়ে কেউ খুব বেশি গুটিয়ে যেতে শুরু করলে, পরবর্তী কালে তার বহির্জগতে মেলামেশায় সমস্যায় সৃষ্টি হতে পারে। তাই তাকে বন্ধুদের দিকে এগিয়ে দিতে হবে। অনেকেরই প্রত্যেক দিন অনলাইন ক্লাস থাকছে। তার ফাঁকে ফাঁকে বা তার পর বন্ধুদের সঙ্গে যেটুকু কথা হয়, সেটুকুই কিন্তু ওদের কাছে অক্সিজেনের মতো। অনেকেই ছোটদের হাতে ফোন দিতে চান না। কিন্তু এখন এই গৃহবন্দি জীবনে ওকে এটুকু আনন্দ থেকে বঞ্চিত করবেন না। এতে ওর মনের কথা ও শেয়ার করতে পারবে। তবে ফোনে কতক্ষণ কথা বলবে, তার যেন মাপকাঠি থাকে।
• সপ্তাহে অন্তত এক দিন ওকে সঙ্গে নিয়ে বেরোন। ওরা ওদের মতো করে পরিস্থিতি সামলাচ্ছে। অনেক সময়েই ওরাও হয়তো ভয় পায়। কারণ বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে তাদের বাড়ির কারও করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পেতে পারে। যা ওদের মনের উপরে প্রভাব ফেলতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে। অসুখ-বিসুখ, মৃত্যুকে বোঝার মতো পরিণত কিন্তু ওরা এখনও হয়নি। ওরা সবে বুঝতে শিখছে, তার মধ্যেই এই অতিমারির হানা। সন্তান যখন সবে টক, ঝাল, মিষ্টি, নোনতা... স্বাদ বুঝতে শেখে, সে সময়ে তার মুখে ঝাল বা তেতো ছোঁয়ালে সে কিন্তু পরের খাবারও খেতে চায় না। ঠিক তেমনই জীবনের এই কঠিন দিকটা তারা হয়তো বুঝতে পারছে না। ফলে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। তাই প্রয়োজন মতো সন্তানের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করাও দরকার।
• তাদের নিউ নর্মাল জীবনের সঙ্গে পরিচয় করান। মাঝেমধ্যে মাস্ক পরে ফ্ল্যাটের নীচ থেকে একটু ঘুরে আসতে বলুন। সোশ্যাল ডিসট্যান্স বজায় রাখতে শেখান। প্রথম কয়েক দিন নিজে সঙ্গে করে বেরোন। তাকে পুরো বিষয়টা বুঝিয়ে শিখিয়ে নিয়ে বেরোন। রাস্তায় খেয়াল রাখুন, সে বারবার মুখে হাত দিচ্ছে কি না বা মাস্ক খুলে ফেলছে কি না... ঠিক কোন কোন স্টেপে ভুল করছে। বাড়ি ফিরলে ধরে ধরে সেগুলি বুঝিয়ে দিন। দেখবেন, পরের দিন সেগুলি আর করবে না।
টিনএজার
এখন থেকেই কিন্তু দায়িত্ববোধ তৈরি হয়। টিনএজার সন্তানদের বাড়িতে আটকে রাখবেন না। পায়েলের কথায়, ‘‘বরং ওদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে শেখান। বন্ধুবান্ধুব বা কাছাকাছি ফ্ল্যাটে কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তাঁদের কোনও বাজার লাগবে কি না, খোঁজ নিতে বলুন। কিছু জিনিস কিনে তাঁদের দরজায় রেখে আসতে বলুন। বাড়িতে ওদের হাতে মাস্ক ও স্যানিটাইজ়ার তৈরি করার জিনিস তুলে দিন। বাড়িতে বসেই তা বানাতে বলুন। কিছু মাস্ক ও স্যানিটাইজ়ার আনাজওয়ালা বা দুঃস্থদের মধ্যে বিলি করতে বলুন। এতে ওরা যেমন দায়িত্ব নিতে শিখবে, বাইরের দুনিয়াটাও অন্য ভাবে দেখতে শিখবে। বাইরের যে মানুষটি ওর কাছ থেকে সাহায্য পাবে, তার কৃতজ্ঞতা ওর কাছে সম্মানের মতো।
বয়ঃসন্ধিতে ওদের কাছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’’
সন্তানকে তো চিরকাল ঘরে আটকে রাখতে পারবেন না। বরং এই নিউ নর্মাল জীবনের সঙ্গে ওদের পরিচয় করান। বাইরের জগতে যাতে সে মাথা উঁচু করে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে, সেই প্রস্তুতি না হয় শুরু হোক আগে থেকেই।