Fairness

মাই ‘ফেয়ার’লেডি...

রঙের গণ্ডিতে আর বদ্ধ নয়। ফেয়ার শব্দটির অর্থ হোক সর্বাঙ্গসুন্দর... রঙের গণ্ডিতে আর বদ্ধ নয়। ফেয়ার শব্দটির অর্থ হোক সর্বাঙ্গসুন্দর...

Advertisement

মধুমন্তী পৈত চৌধুরী

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০২০ ০২:২৯
Share:

ইংরেজি ‘ফেয়ার’ শব্দটির অর্থ দু’টি— ফর্সা এবং ন্যায়সঙ্গত। আপাতদৃষ্টিতে, দু’টি অর্থের মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। কিন্তু সমাজে যখন চামড়ার একটিমাত্র রংকে নীতিসম্মত বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়, তখন মনে হয় শব্দটির প্রয়োগে কি ভুল রয়ে গিয়েছে? শুধু শব্দচয়ন বা তার প্রয়োগে নয়, ভুল রয়ে গিয়েছে মানুষের মনে, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে।

Advertisement

সৌন্দর্যের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা

বাড়ির এক আদুরে কন্যেকে দেখিয়ে যখন কোনও বয়োজ্যেষ্ঠ বলেন, ‘‘ও তো ফর্সা, ওকে বেশি সাজতে হবে না...’’, মেয়েটি খুশি হয়। জিনগত কারণে পাওয়া গায়ের রঙের জন্য হয়তো সে খানিক শ্লাঘাও অনুভব করে। সেই বাড়ির অন্য আর এক মেয়েকে তখন শুনতে হয়, ‘‘ওকে একটু বেশি করে ক্রিম মাখাও, যাতে দেখতে ফর্সা লাগে...’’, সে হয়তো ভাবে জীবনের প্রতি পদে তাকে একটু ‘বেশি’র দিকেই ঝুঁকে চলতে হবে। কারণ তার চামড়ার স্বাভাবিক রং সমাজের চোখে প্রশংসনীয় নয়।

Advertisement

গায়ের রঙের নিরিখে সৌন্দর্যের এই অপব্যাখ্যা কয়েক প্রজন্মের ফসল। জাতপাতের ভেদ, ব্রাহ্মণ্যবাদের একাধিপত্য বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছে...ফর্সা মানেই সুন্দর, যা আদপে ভিত্তিহীন।

কিন্তু এই তত্ত্বই সমাজের মনে চিরন্তন সত্যের আকার নিয়েছে, যার মূলে কুঠারাঘাত করা সহজ নয়। ৪৫ বছর ধরে জনপ্রিয় একটি প্রসাধনী দ্রব্যের নাম থেকে ‘ফেয়ার’ শব্দটির অপসারণ অনেকের মনে নতুন আশা জাগিয়েছে। আবার কারও মতে, এটা শুধু বিজ্ঞাপনী কৌশলমাত্র।

‘আমি ব্রাহ্মণ কিন্তু ফর্সা নই...’

নামী মডেল ও গ্রুমিং বিশেষজ্ঞ নয়নিকা চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘মডেলিং দু’রকমের, কমার্শিয়াল (বিজ্ঞাপন, হোর্ডিং) আর র্যাম্প। ফর্সা-কালোর ভেদাভেদ র্যাম্পে কখনও ছিল না। থাকলে আমি এত সফল হতে পারতাম না। কিন্তু বিজ্ঞাপনের জগতে ফর্সা মেয়েদেরই চাওয়া হত। আমি নিজে হাতে গোনা কয়েকটিই বিজ্ঞাপন করেছি। গত কয়েক বছরে হয়তো বিজ্ঞাপনের জগতে কিছুটা বদল এসেছে।’’ বাংলার জনপ্রিয় একটি গয়নার ব্র্যান্ডের মুখ অভিনেত্রী তুহিনা দাস। ওই বিজ্ঞাপনে অবশ্য শ্যামবর্ণা অভিনেত্রীকে তাঁর গায়ের স্বাভাবিক রঙেই দেখা গিয়েছে।

উঠতি মডেলদের যখন নয়নিকা গ্রুমিংয়ের পাঠ শেখান, তাঁদের কী ভাবে আত্মবিশ্বাস জোগান? ‘‘যখনই কেউ বলে, আমি ওর মতো হতে চাই... বলি, তা হলে আমার ক্লাসে এসো না। গ্রুমিং মানে নিজেকে ডেভেলপ করা, আর এক জনের মতো হয়ে ওঠা নয়। অনেকে বলে, সুস্মিতা সেনের মতো হতে চাই। বলি, সুস্মিতা কিন্তু ফর্সা নয়। বুঝতে পারি, ওরা ছোটবেলা থেকে এটাই শুনে আসছে... সুন্দর মানে ফর্সা, ফর্সা মানে উচ্চবর্ণ। আমি বলি, ব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে আমি কিন্তু ফর্সা নই...’’

কনের গায়ের রং কেমন?

ফর্সা-শ্যামবর্ণের দ্বন্দ্ব সমাজ-পরিবারের অন্য কোনও স্তরে খুব প্রকট না হলেও, বিয়ের বাজারে তার নগ্ন রূপ স্বমহিমায় বিরাজমান। পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন, ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটের একাধিক ফিল্টার-এ চলে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। সম্প্রতি একটি নামী সাইট তাদের রঙের ফিল্টার তুলে নিলেও, অন্য সাইটগুলিতে তা দিব্যি বহাল। কনের পরিবার এবং ক্ষেত্রবিশেষে পাত্রী নিজেই মেকআপ-শিল্পীর কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ রাখে, বিয়ের সাজে তাকে দেখতে ফর্সা লাগুক। তবে বিষয়টিকে শহরের দুই জনপ্রিয় মেকআপ-শিল্পী দু’ভাবে দেখছেন। অনিরুদ্ধ চাকলাদার বলছিলেন, ‘‘কেউ যদি নিজেকে ফর্সা দেখাতে চান, সেটা কিন্তু তাঁর চয়েস। তাঁকে যদি বলা হয়, এটা করবেন না... তবে কিন্তু সেটাও চাপিয়ে দেওয়া।’’ আবার অভিজিৎ চন্দ বললেন, ‘‘খুব কমসংখ্যক কনেই বলেন, তাঁর স্কিনটোন অনুযায়ী সাজাতে। এটা শুনে খুব খুশি হই।’’ তবে দুই শিল্পী সহমত, স্কিনটোনের কাছাকাছি থেকেই সাজগোজ করা ভাল।

মেকআপের এ-কাল সে-কাল

কয়েক দশক আগেও কনের গায়ের রং যেমনই হোক, বিয়ের দিনে তাকে ফর্সা দেখানোর একটা চেষ্টা থাকত। অনিরুদ্ধ বলছিলেন, ‘‘এটার একটি অন্য কারণও রয়েছে। ওই সময়ে ফাউন্ডেশন ছিল হাতে গোনা দু’-তিনটি। তাই সকলেই সেটা ব্যবহার করত। যার স্কিনের সঙ্গে মানিয়ে গেল, তাকে দেখতে ভাল লাগত। আর না মানালে সাজ খোলতাই হত না।’’

এখন ফাউন্ডেশনের ভ্যারাইটি, শেড অনেক বেশি। তাই হালফিল কনেদের অনেকেই স্কিনটোনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সাজার পক্ষপাতী। অনিরুদ্ধ বলছিলেন, ‘‘ব্রাইডাল লুক ফেয়ার না হলেও ব্রাইট সকলেই চায় এবং প্রফেশনাল মেকআপ শিল্পীদের দিয়ে করালে দেখনদারির ব্যাপারও থাকে।’’

মেকআপের সাত-সতেরো

মেকআপ করার পাশাপাশি স্কিনে তা কতটা বসছে, সেটা দেখা জরুরি। বিয়ের ক্ষেত্রে সব সময়ে টাচআপ করা সম্ভব হয় না। তবে মেকআপ যদি অক্সিডাইজ়ড হয়, একটা নীলচে-গোলাপি আভা চলে আসে সাজে। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় আর্দ্রতা বেশি হওয়ার কারণেও মেকআপ করতে অনেক সমস্যা দেখা যায়।

অনিরুদ্ধের কথায়, ‘‘আমাদের স্কিনে দু’রকম কালার টোন থাকে। ট্যানের কারণে একটা ডার্ক টোন, একটা লাইট টোন। যে কোনও একটা টোন ধরে মেকআপ করা হয়। লাইট টোন ধরে মেকআপ করলে তুলনায় উজ্জ্বল বেশি দেখায়। ডার্ক টোন ধরে করলে একটু চাপা দেখায়।’’ আবার খুব ফর্সা মেয়েদের বিয়ের সাজে মেকআপ চেপে দেওয়া হয়। যাতে ছবিতে দেখতে খুব সুন্দর লাগে। তবে এ সব একান্তই ব্যক্তিগত চয়েস।

একটি বিজ্ঞাপনের বদলে রঙের ভেদাভেদ ঘুচবে না। তবে চিরাচরিত ধারণায় একটা আঘাত তো বটে। কে বলতে পারে, পরবর্তীতে এই ছিদ্রপথই হয়তো ক্রমশ বড় হতে হতে দীর্ঘ কালের বদ্ধ ধারণায় ধস নামাবে এবং নতুন ভাবনার স্রোত বইবে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement