প্রতিদিন ফোন করতেন নিজের পরিচিত চিকিৎসককে। কোয়রান্টিন কেন্দ্র বা কোভিড-১৯ চিকিৎসাকেন্দ্রে ডিউটি পড়লে কী করবেন, তা জানার জন্য। উদ্বেগ এতই যে একসঙ্গে প্রায় দুশোটি মাস্কের অর্ডার দিয়েছিলেন। নিজে চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও ‘ডক্টর শপিং সিম্পটম’-এর শিকার হয়ে পড়েছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি।
ঘটনাটির উল্লেখ করে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টস’-এর (আইএসিপি) সাম্মানিক জেনারেল সেক্রেটারি মনোজ কে বজাজ বলছেন, ‘‘ছেলেটি আমার ছাত্র। নিজে চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও ডক্টর শপিং সিম্পটম তৈরি হয়েছিল তাঁর মধ্যে। আসলে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মানসিক স্বাস্থ্যের উপরেও গুরুতর প্রভাব ফেলেছে। যার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে এই উপসর্গের মাধ্যমে। এমনকি, সাধারণ কাশি, হাঁচি হলেও অনেকে ভাবছেন তাঁরা সংক্রমিত হয়ে পড়েছেন। তার পরেই চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়ার পর্ব শুরু, যা প্রায় থামতেই চাইছে না।’’
মনোবিদদের একটি অংশের মতে, সাধারণ সময়ে অনেকের মধ্যেই ‘ডক্টর শপিং সিনড্রোম’ দেখা যায়। এই সিনড্রোম যাঁদের মধ্যে থাকে, তাঁরা ঘনঘন চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। সব সময়েই তাঁরা মনে করেন, তাঁদের মধ্যে কোনও না কোনও অসুস্থতা রয়েছে। এমনকি, স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট স্বাভাবিক এলেও তাঁরা নিশ্চিন্ত হতে পারেন না যে, তাঁরা সম্পূর্ণ সুস্থ। এই উপসর্গের মাত্রা বেশি হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে ‘হাইপোকনড্রিয়াসিস’-এর লক্ষণ ফুটে ওঠে। যার সহজতম অর্থ হল, স্বাস্থ্য নিয়ে অত্যধিক দুশ্চিন্তা করা। কোনও বড় অসুখ হয়ে যাওয়ার আতঙ্ক সব সময়ে তাড়া করে তাঁদের। এক মনোবিদের কথায়, ‘‘সিনড্রোম ব্যাপারটা দীর্ঘস্থায়ী। রোগ হয়ে যায়নি তো!—এই আশঙ্কা নির্মূল করতেই তাঁরা বার বার চিকিৎসক দেখান, নানা শারীরিক পরীক্ষা করাতে থাকেন। কিন্তু আশঙ্কা নির্মূলের পরিবর্তে অসুস্থ হওয়ার ভয় আরও জাঁকিয়ে বসে তাঁদের মধ্যে। এখন সংখ্যা গরিষ্ঠের মধ্যে যা দেখা যাচ্ছে, তা হল ‘ডক্টর শপিং সিম্পটম’।’’
‘ডক্টর শপিং সিনড্রোম’ কী
নিজের শারীরিক অবস্থা নিয়ে সর্বদা সংশয়-দুশ্চিন্তা, একাধিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই হল ‘ডক্টর শপিং সিনড্রোম'। ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্স সংক্রমণের সময়েও দেখা গিয়েছিল এই সিনড্রোম। বিশ্ব জুড়ে চলতে থাকা করোনা আতঙ্কে ফের বাড়ছে এই রোগের উপসর্গ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের একাংশও এই উপসর্গের শিকার বলে মনে করছেন মনোবিদেরা। তাঁদের এ-ও অনুমান, এই কারণেই অনেক জায়গায় চিকিৎসক-নার্সেরা কাজে যোগ দিচ্ছেন না। অনেকে আতঙ্কে কর্মস্থল ছেড়ে নিজের বাড়ি চলে যাচ্ছেন। ভিন্ রাজ্যের নার্সদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে যাওয়ার পিছনে এই বিশেষ উপসর্গ কাজ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন মনোবিদেরা। কোভিড-১৯ চিকিৎসাকেন্দ্রে কর্মরত সরকারি এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘প্রতিদিন এই পরিবেশে কাজ করতে করতে যদি নিজের মধ্যে সংক্রমণ নিয়ে কোনও উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা তৈরি হয়, তা হলে সেটা কি অস্বাভাবিক? যেখানে নিজের অনেক বন্ধু-সহকর্মীকে আক্রান্ত হতে দেখছি!’’
মনোবিদেরা জানাচ্ছেন, একদমই অস্বাভাবিক নয়। বরং তা স্বাভাবিক। মনোজ কে বজাজের কথায়, ‘‘একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, এই সিম্পটম কোনও শ্রেণিভিত্তিক নয়। সমাজের যে কোনও স্তর, যে কোনও পেশার মানুষই এর শিকার হতে পারেন।’’ কোভিড-১৯ সংক্রান্ত মানসিক বিপর্যয়ের কাউন্সেলিংয়ের জন্য আইএসিপি গঠিত বিশেষ ‘ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট টাস্ক ফোর্স’-এর সদস্য তথা কলকাতার মানসিক চিকিৎসার উৎকর্ষকেন্দ্র ‘ইনস্টিটিউট অব সাইকায়াট্রি’-র ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক প্রশান্তকুমার রায় বলছেন, ‘‘বিষয়টি চিন্তার তখনই হবে যখন সংক্রমণ থামার পরেও সমাজের বিশেষ শ্রেণির মধ্যে এই উদ্বেগ থেকে যাবে এবং তা স্বাভাবিক জীবনযাপনের ছন্দকে নষ্ট করবে।’’
মনোবিদদের একাংশের অনুমান, করোনার কারণে শারীরিক বা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া রোগীদের কমপক্ষে ৩০-৪০ শতাংশের মধ্যেই এই উপসর্গ থেকে যাবে। ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেল্থ, গাঁধীনগর’ (আইআইপিএইচ-জি)-এর বিজ্ঞানী-মনোবিদ তথা ‘ইকনমিক ইভ্যালুয়েশন স্পেশালিস্ট’ অপূর্বকুমার পাণ্ড্য বলেন, ‘‘অতীত দেখলেই বোঝা যাবে, মহামারি থামার পরেও সংক্রমণজনিত ভয় এক শ্রেণির মানুষের মধ্যে স্থায়ী ভাবে থেকে গিয়েছে। স্বাস্থ্য-সচেতন হওয়া ভাল। কিন্তু অকারণ দুশ্চিন্তা অথবা বার বার চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করতে পারে।’’
শপিং মল, দোকান বন্ধ থাকায় ‘উইন্ডো শপিং’ আপাতত বন্ধ। তার পরিবর্তে ‘ডক্টর শপিং’ জায়গা নেবে কি না, আপাতত তাই ভাবাচ্ছে মনোবিদ-চিকিৎসকদের।
আরও পড়ুন: বাড়ি থেকে কাজই কি এখন নতুন কর্মসংস্কৃতি