ইন্দ্রজিতের পুজোর পেটপুজোয় একসূত্রে বাঁধা পড়েছে এ কাল-সে কাল। ছবি: সংগৃহীত।
দুর্গাপুজো ব্যাপারটা আমাদের কাছে যতটা ধর্মীয়, তার সমান বা হয়তো তার থেকেও বেশি এখন সামাজিক উৎসবের রূপ নিয়েছে। দশটা লোক একসঙ্গে মিলে আমোদ-আহ্লাদে ব্যস্ত। চাঁদা তোলা থেকে শুরু করে প্রতিমা বিসর্জন, পুরো ব্যাপারটা ম্যানেজ করার মধ্যে কিন্তু এক অন্য আনন্দ আছে! আর পুজোর সময় ইয়ার-দোস্ত মিলে যে নরক গুলজারটা করেন, তাকে নয় না-ই ধরলাম। তবে ম্যাডামরাও এই একটা ব্যাপারে কম যান না। কারও দিকে না তাকিয়ে বাঁকা চোখের পলকে দেখে নেওয়া, কে কার সঙ্গে প্রেম করছেন, কোন দিদি কী পরেছেন, সেই পোশাকের যাবতীয় খুঁটিনাটি— এগুলি তাঁরা যে রকম সুচারু পারদর্শিতার সঙ্গে করে থাকেন, তা করার সাধ্যি কোনও পুরুষেরই নেই। এ সবের পাশাপাশি পুজোর ‘ভোজ’বাজিকে বাদ দিলে কিন্তু চলবে না। দশ কথার এক কথা, পুজোর সময় যে খাওয়াদাওয়াটি হয়, আমা হেন পেটুকের কাছে তার মাহাত্ম্য কিন্তু একটুও কম নয়। দুর্গাপুজোর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক জানা-অজানা পেটপুজোর গল্প। আসুন, একটু খুঁজে দেখা যাক।
পলাশির যুদ্ধে বিজয়লাভের পর কলকাতার কিছু বাবু প্রথম দুর্গাপুজা শুরু করেন কলকাতা গ্রামে। শহর কলকাতা তখনও গড়ে ওঠেনি। কলকাতা তখনও এক গ্রাম মাত্র। কথিত আছে যে, সেই পুজোয় কলকাতার কিছু বড়লোক পরিবার ছাড়া প্রবেশাধিকার ছিল কেবলমাত্র সাহেবদের। সাধারণ মানুষের সেই আমোদে শামিল হওয়ার কোনও অধিকারই ছিল না। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর এক। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে গুপ্তিপাড়ার (মতান্তরে হুগলির) কিছু যুবক এই ব্যাপারটায় বিরক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে প্রথম সার্বজনীন দুর্গাপুজোর প্রবর্তন করেন। আর কথিত আছে যে, এই বারো জন ইয়ারের পুজো থেকে ‘বারো-ইয়ারি’ বা ‘বারোয়ারি’ পুজো শব্দটির উদ্ভব। বাবু রামচরণ রায় মশাইয়ের ‘কলকাতা বিচিত্রা’ বইতে আমরা কলকাতার বারোয়ারি পুজোর উল্লেখ পাই। দুর্গাপুজো আসলে কিন্তু বাড়ির মেয়ের বাপের বাড়ি ফেরার আমোদের বহিঃপ্রকাশ। ফলে খাওয়াদাওয়া হবে না, এটা হতেই পারে না।
পুজোর ভোগের খিচুড়ির স্বাদের কোনও তুলনাই নেই। ছবি: সংগৃহীত।
ও পার বাংলায় যেখানে পুজোর সময় আমিষ আনতেই হয় বাড়িতে, এ পার বাংলায় আবার নিরামিষ বৈষ্ণব আচরণবিধির মান্যতা বেশি। এর কারণ শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাব হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। শাক্তমতে যে কোনও পুজোয় বলি দেওয়ার রীতি প্রচলিত। অষ্টমী যখন শেষ হয় আর নবমী যখন শুরু হয়, সেই সন্ধিক্ষণই বলির আদর্শ সময়। মা দুর্গাকে এই সময় চামুণ্ডারূপে পুজো করা হয়। সেই চামুণ্ডা, যিনি চণ্ড ও মুণ্ড, দুই অসুরকে নাশ করেছিলেন। কচি পাঁঠার মাংসকে পেঁয়াজ রসুন ছাড়া রান্না করা হয় ভোগের জন্য। প্রাচীনকালে অব্ৰাহ্মণদের ঠাকুরকে রান্না করা ভোগ দেওয়ার অধিকার ছিল না। এ দিকে মা দুর্গা যে বাড়ির মেয়ে! দু’মুঠো ভাত তাঁকে না দিলে হয়? তাই বাড়ির মেয়েকে চাল-কলা মেখে দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়। এর সঙ্গে হরেক রকম ফলমূল আর মিষ্টি তো থাকবেই। দশমীর দিন কিন্তু আলাদা গল্প। মেয়ে সে দিন শ্বশুরবাড়ি ফিরবে, তাই বাড়িতে সকলের মনখারাপ, মুখ ভার, রান্না করার দিকে কারওরই মন নেই। ফলে আগের দিনের রান্না করে রাখা পান্তাভাত খাওয়ার রীতি, যাকে কিনা বলা হয় শীতলভোগ। আর বাড়িতে সব সময়েই একটা ধারণা থাকে যে, শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় বাড়ির যা ভাল জিনিস, মেয়েকে তা খাইয়ে দিতে হবে। এখানেও তার অন্যথা হয়নি। বাড়িতে তৈরি বড়ি, আচার ইত্যাদির প্রচলন আমরা দেখতে পাই এই সময়।
এত গল্পের পরে আসুন আমরা আবার একটু আধুনিক সময়ে ফিরে আসি। আমাদের যৌবনকালে বা কৈশোরে দুর্গাপুজো ছিল সাপের পাঁচ পা দেখার সময়। বাড়ির থেকে যে সামান্য টাকা পাওয়া যেত, একটা সময় সে উড়ে যেত সিংহ ব্র্যান্ড ক্যাপ আর আলুকাবলি কিনতে। যবে সামান্য জ্ঞানবুদ্ধি হল, সেটি গেলো সিগারেট কিনতে। আর একটু লেজ গজালে নেশা জাগলে পুজোর সময় অপটু হাতে নতুন শাড়ি আর লিপস্টিক সামলে ফুচকা মুখে ফেলা প্রেমিকার লাল নাক আর হাসিমাখা চোখ দেখার। তাদের সামনে হিরো সাজার চক্করে সে ফুচকার দামও বেশির ভাগ সময়ে আমাদেরই পকেট থেকে খসত। তবে তখন আমিই বা কে আর রাজাই বা কে? একটা কথা কিন্তু মানতে হবে, মাঝরাতে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে অপটু কিশোরের হাতে বানানো এগরোলে যে স্বাদ আমি পেয়েছি, সাধারণ সময়ে অনেক বড় দোকানে সে স্বাদ খুঁজে ফিরেছি পরে বহু সময়ে। এ ছাড়া লাল শালু ঢাকা হাঁড়ির বিরিয়ানি বা চিকেনের ছাঁটের মোমো— সে পুজো ইস্পেশাল খাবারের যিনি স্বাদ নেননি, এ জন্ম যে তাঁর যে খুব সার্থক, এমনটা বলা যায় না।
পুজোর মেনুতে সকালে লুচি-তরকারি থাকতেই হবে। ছবি: সংগৃহীত।
এখন অবশ্য বয়স হয়ে গিয়েছে। কমপ্লেক্সের প্যান্ডেলে সকাল থেকে বসে জ্ঞান দেওয়া আর পুজো কমিটির খাবারের খুঁত ধরা ছাড়া বিশেষ একটা কাজ নেই। কিন্তু বাকি খাবারে যা-ই হোক, অষ্টমীর সেই খিচুড়ির স্বাদ শত চেষ্টাতেও যেন বাড়িতে আসে না। আর সুয্যিমামা ডুবলে কোনও এক বন্ধুর বাড়িতে আশির দশকের গান চালিয়ে দুঃখবিলাসের সঙ্গে সুরাপানের যে কি আনন্দ, সে বলে বোঝানো যায় না।
বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে নানা প্রকার খাবারের স্বাদ চেখে দেখাই এখন আমার কাজ। তাই সারা বছরই যে কী ভাল ডায়েটের মধ্যে থাকি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পুজোর কথা হবে আর প্রেমের কথা হবে না, তাই আবার হয় নাকি! আমার জীবনের প্রথম প্রেম কিন্তু লুচি আর সাদা আলুর তরকারি। আর তার পরেই প্রেমে পড়েছি বিরিয়ানির। এক থালা ভাত, সঙ্গে দুটো মাংস, আলুটা না হলেও চলে— এ খাবার যত বার আমার সামনে আসে এখনও তার প্রেমে পড়ি নতুন করে।
বাঙালির জীবনে পুজোর খাওয়াদাওয়ার বরাবরই এক আলাদা স্থান ছিল, আছে আর থাকবেও। পুজোর সময় আমার ছেলেকেও কোনও দিন নিশ্চয়ই আমি ভারী গলায় বলব, ‘‘বাইরে যে কোনও কিছু খেয়ো না যেন’’, আর ও বেরিয়ে গেলে গিন্নির দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসব! কী খেতে বারণ করলাম সে নয় না-ই বা বললাম ......