জানলার গ্রিলে তুলসি গাছ, বারান্দার লোহার তেপায়ায় প্লাস্টিকের টবে অর্কেরিয়া— এমনটাই এত দিন চোখে পড়েছে। কিন্তু বহুতলের ব্যালকনি কিংবা ব্যস্ত শহরের ঘিঞ্জি গলির বাড়ির ছাদের টবে বাণিজ্যিক ভাবে সব্জি চাষ করলে কেমন হয়?
নেহাত শখেই বাড়ির ছাদে টবে ব্রকোলি, চাইনিজ ক্যাবেজ, লাল বাঁধাকপি বা ক্যাপসিকাম লাগিয়েছিলেন শ্যামনগরের পুষ্পিতা ঘোষ, বেলঘরিয়ার অনিকেত হাজরা। প্রথম বছরেই আশাতীত ফলন। দ্বিতীয় বছরেও তাই। প্রতিবেশী, আত্মীয়-পরিজনকে দেদার বিলিয়েও পড়ে থাকছে আরও আরও। কাজেই বাড়িতে না পচিয়ে ঠেলাগাড়িতে আসা পাড়ার সব্জি বিক্রেতার কাছে বিক্রি করার বুদ্ধিটা মাথায় আসে। তাতে দু’পয়সা রোজগার হওয়ায় টবে সব্জি ফলানোর ইচ্ছেটা আরও বাড়ে, জানাচ্ছেন পুষ্পিতা, অনিকেতরা।
কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, পছন্দসই সব্জি দু’কামরার ফ্ল্যাটবাড়ির ব্যালকনি কিংবা ছাদেও ফলানো সম্ভব। সামান্য কিছু পদ্ধতি মেনে চাষ করলে অল্প সময়ে বেশি ফলন দিতে পারে টোম্যাটো, বেগুন, মরিচ, শশা, ঝিঙে, মিষ্টি কুমড়ো, মটরশুটি, কলমি শাক, লাউ, পুঁই শাক, পেঁপে, পুদিনা পাতা, ধনে পাতা, থানকুনি, লেটুস, ব্রকোলি, লাল বাঁধাকপি।
সুবিধা
অতিরিক্ত সার, রাসায়নিক কীটনাশকের বদলে ঘরোয়া পদ্ধতিতে তৈরি জৈব সার ব্যবহার করায় রাসায়নিক বিষমুক্ত জৈব সব্জি মেলে।
রোজকার খাবারের সব্জি কেনার খরচ নেই। উপরন্তু বিক্রি করে উপার্জনের সুযোগ। না হলে পাড়া-পড়শিকে বিলিয়ে শান্তি।
গাছ-গাছালিতে ঘরের শোভা বাড়ে। সংসারের অব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের পাত্র ও সরঞ্জামকে এই কাজে ব্যবহার করা যায়।
গরম, অতিরিক্ত বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝা ইত্যাদির কবল থেকে টবের সব্জিকে সহজে রক্ষা করা যায় অন্য দিকে সরিয়ে নিয়ে। পশু-পাখির উপদ্রব থেকে বাঁচানো সহজ।
টবের মাটি তৈরি
শাক-সব্জির বীজতলার জন্য মাটি হতে হবে ঝুরঝুরে, হালকা এবং জল ধরে রাখার ক্ষমতাসম্পন্ন। মাটি চালনি দিয়ে চেলে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। দুই ভাগ বেলে দো-আঁশ মাটির সঙ্গে দুই ভাগ জৈব সার মিলিয়ে নিয়ে বীজতলার মাটি তৈরি করে নিতে হয়। মাটি যদি এঁটেল হয়, তা হলে বীজের অঙ্কুরোদগমের সুবিধার জন্য এক ভাগ বালি মিশিয়ে হালকা করে নিতে হবে। মাটিকে শোধন করে জীবাণুমুক্ত করে নিয়ে চারাকে রোগবালাই থেকে রক্ষা করা সহজ। সাধারণত এক লিটার ফরমালডিহাইড শতকরা ৪০ ভাগ ৪০ লিটার জলে মিশিয়ে এই দ্রবণের ২৫ লিটার প্রতি ঘনমিটার মাটিতে কয়েক কিস্তিতে ভিজিয়ে দিতে হয়। এরপরে দু’দিন চটের কাপড় দিয়ে মাটি ঢেকে রেখে পরে চট উঠিয়ে দিলে মাটি জীবাণুমুক্ত হয়ে যাবে।
বীজ বপন ও সেচ
মাটি হালকা ঝুরঝুরে করে টবের উপরের ভাগ সমতল করতে হবে। খুব হালকা ভাবে বীজ ছড়িয়ে দিতে হবে টবের ভেতর। এরপরে জৈব সার দিয়ে বীজগুলিকে ঢেকে দিতে হবে। জল দিতে হবে নিয়মিত ছোট ছোট ছিদ্রযুক্ত ঝাঁঝরি দিয়ে। লক্ষ্য রাখতে হবে, জলের ঝাপটায় যাতে বীজের উপর জৈব সারের আবরণ সরে না যায়। যে সব বীজ আকারে ছোট সেগুলোর ক্ষেত্রে জল দিলে বীজ জলের ধাক্কায় একত্র হয়ে অঙ্কুরোদগমে সমস্যা ঘটতে পারে। এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে।
পরিচর্যা
অনেক সময় শাক-সব্জির চারা বিভিন্ন প্রকার পাখি, পিঁপড়ে, মাকড়শা ইত্যাদি নষ্ট করে ফেলতে পারে। সে জন্য হেপ্টোক্লোর ৪০ পরিমাণ মতো দিলে কাজ দেবে। পাখির হাত থেকে ফসল বাঁচাতে হলে টবের উপরে তার বা নাইলনের জাল দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে।
আগাছা নিড়ানি দিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ফেলে দিতে হবে। কিন্তু চারার গোড়ায় যেন আঘাত না লাগে।
শাক-সব্জির টবগুলি অবশ্যই আলো-বাতাস পায়, এমন জায়গায় রাখা দরকার। তবে অতিরিক্ত ঝড়-বৃষ্টি-রোদ-তাপ থেকে রক্ষা করার জন্য সাময়িক ভাবে টব ঘরের ভিতর নিরাপদ স্থানে সরানো যেতে পারে।
মাটিতে রস আছে কি না সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। গরমের সময় বিকেলে নিয়মিত জল দেবেন। বিকেলে দিলে জলের বাষ্পমোচন কম হয়, জলের কণা ধীরে ধীরে মাটির কণাকে সিক্ত করে, মাটির রস গরম হয়ে গাছের শিকড়ের ক্ষতি করে না।
শুকনো ও রোগগ্রস্ত পাতা দেখামাত্রই জীবাণুমুক্ত ছুরি বা ব্লেডের সাহায়্যে কেটে ফেলতে হবে। পোকার ডিম, শুককীট ও মথ দেখামাত্র নষ্ট করে ফেলতে হবে। পোকার আক্রমণ হলে নিম তেল (প্রতি লিটার জলে ৩ মিলি) দেওয়া যেতে পারে।
সব্জি সংগ্রহ
সব্জি বেশি দিন গাছে না রেখে, নরম থাকতেই তুলে নেওয়া ভাল। এতে এক দিকে যেমন সব্জির গুণগত মান ভাল হয়, অন্য দিকে, গাছে আরও বেশি সব্জি আসে। তবে সব্জি ছেঁড়া যাবে না। আস্তে করে কেটে নিতে হবে।