সেপ্টিসেমিয়া বা সেপসিসের কারণে মৃত্যু—চেনা মহলে কথাটির সঙ্গে কম-বেশি সকলের পরিচয় রয়েছে। শরীরের যে কোনও অঙ্গের সংক্রমণ (ইনফেকশন) সেপসিসের আকার ধারণ করতে পারে। সাধারণত ব্যাকটিরিয়াজনিত সংক্রমণের ক্ষেত্রে সেপ্টিসেমিয়ার কথা বলা হয়। ভাইরাসঘটিত সংক্রমণের ক্ষেত্রে নয়। ল্যাটিন ‘এমিয়া’ কথাটির অর্থ রক্ত। ফুসফুস, কিডনি, খাদ্যনালি বা অন্য যে কোনও অঙ্গের সংক্রমণ যখন রক্তে প্রবেশ করে, তখন তাকে বলা হয় সেপ্টিসেমিয়া। ধরা যাক, কোনও ব্যক্তির ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছে। সাধারণত ফুসফুসের সংক্রমণ বলতে নিউমোনিয়া বোঝানো হয়। এ বার ফুসফুসের সংক্রমণ যদি রক্তে প্রবেশ করে, তখন সেটি সেপ্টিসেমিয়া। এর কারণে দেহে যে ক্রিয়া-বিক্রিয়া শুরু হয়, তার ফলে অন্যান্য অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি এর জেরে একাধিক অঙ্গ অকেজো হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। এই অবস্থাকে বলা হয় সেপসিস।
কয়েকটি গোড়ার কথা
আমাদের শরীরে প্রত্যহ একাধিক ব্যাকটিরিয়া প্রবেশ করে। ব্যাকটিরিয়ার সঙ্গে শরীরে তৈরি হওয়া প্রোটিন উৎসেচক বা কেমোকাইন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে তাকে মেরে ফেলে। ফলে তা শরীরের ক্ষতি করতে পারে না। তবে তেমন ক্ষতিকর ব্যাকটিরিয়া যদি শরীরে প্রবেশ করে, তখন তার সঙ্গে লড়াইয়ে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরাজিত হলে, রোগের প্রকাশ ঘটে।
সেপসিস কাদের হতে পারে?
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অরুণাংশু তালুকদারের মতে, যে সব ব্যক্তির স্বাভাবিক রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাঁদের সেপসিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি। যেমন, ডায়াবেটিক রোগী, এইচআইভি পজ়িটিভ ব্যক্তি, ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যক্তি, কিডনির রোগ রয়েছে এমন ব্যক্তি, অতিরিক্ত মদ্যপান করেন এমন ব্যক্তির সেপসিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
তবে সুস্থ ব্যক্তির যে সেপসিস হবে না, এমনটাও নয়। ডা. তালুকদারের কথায়, ‘‘একটি ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা এবং ব্যক্তির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার মধ্যে এক রকমের দ্বন্দ্ব চলে বলা যায়। যার ক্ষমতা বেশি, সে জেতে। অর্থাৎ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল হলেও যদি কোনও শক্তিশালী ইনফেক্টিভ অর্গানিজ়ম শরীরে প্রবেশ করে, তখন রোগের তীব্রতা বাড়বে।’’
সেপসিসের সাধারণ লক্ষণ
যে অঙ্গে সংক্রমণ হচ্ছে, সেই অঙ্গভিত্তিক সংক্রমণের উপসর্গই প্রথমে চোখে পড়ে। যেমন, নিউমোনিয়া হলে কাশি-সর্দি, জ্বরের মতো লক্ষণ দেখা যাবে। পাকস্থলীতে হলে হজমের সমস্যা, বমি, পেটে ব্যথা হতে পারে। ডা. সুবীর কুমার মণ্ডলের মতে, ‘‘যে অঙ্গে প্রথম সংক্রমণ হচ্ছে, সেই সংক্রমণের বৈশিষ্ট্য থাকবে। তবে যে কোনও ধরনের সেপসিসের সাধারণ উপসর্গ হল, রক্তচাপ অস্বাভাবিক পরিমাণে কমে যাওয়া, হৃৎস্পন্দন (পালস রেট) বেড়ে যাওয়া, সচেতনতা কমে যাওয়া, খিঁচুনি, রক্তে শ্বেতকণিকার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে বা কমে যাওয়া, অ্যালবুমিনের পরিমাণ কমে যাওয়া।’’ রক্তের বিভিন্ন উপাদান পরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা নিশ্চিত হন যে, রোগটা সেপসিস কি না। তবে সেই রিপোর্ট আসার আগেই কোনও রকম অস্বাভাবিকতা দেখা গেলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানো প্রয়োজন। সেপসিসের চিকিৎসা বাড়িতে কখনও সম্ভব নয়। প্রাথমিক ভাবে রোগ প্রতিরোধের জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তার উপরেও এই রোগের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়।
রোগ নির্ণয়
সিআরপি এবং রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যা পরিমাপের মতো পরীক্ষা এ ক্ষেত্রে করা হয়। এ ছাড়া ল্যাকটেট এবং প্রোক্যালসিটোনিনের পরীক্ষাও করা হয়। তবে উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়া শেষোক্ত পরীক্ষা দু’টি করা সম্ভব নয়। এই ধরনের নির্ণায়ক দেখে চিকিৎসার রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া রক্তে নিউট্রোফিল এবং লিম্ফোসাইটের অনুপাত নির্ণয়ের মাধ্যমেও সেপসিস হয়েছে কি না, বোঝা যায়।
চিকিৎসা
ডা. মণ্ডল এই রোগের চিকিৎসার নানা দিক সম্পর্কে জানালেন—
* রক্তচাপ কমে যাওয়ার ফলে শরীরে আইভি ফ্লুয়িডের পরিমাণ বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। আবার অ্যালবুমিনের পরিমাণ কমে যাওয়ায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে জল জমে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। সেই কারণে ফ্লুয়িডের পরিমাণ খুব ভেবেচিন্তে ঠিক করা হয়।
* সেপসিস রোগীকে স্টেরয়েড দেওয়া হবে কি না, তা নির্ভর করছে রোগীর সার্বিক পরিস্থিতির উপরে।
* ব্লাড কালচারের রিপোর্ট আসার আগে থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করে দেওয়া হয়। প্রথম যে অঙ্গ থেকে সংক্রমণ ছড়ায়, সেই অঙ্গের জন্য প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে।
* অ্যান্টিবায়োটিক দীর্ঘদিন ধরে চললে সঙ্গে অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ দেওয়া হয়।
* রোগীর এয়ারওয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে। অক্সিজেন দেওয়া, সাকশন করা, রাইলস টিউবের মাধ্যমে খাবার দেওয়ার মতো বিষয়গুলির দিকে নজর দিতে হবে। অচৈতন্য অবস্থায় বা কোমায় থাকা রোগীকে ৩০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গলে শোয়াতে হবে।
* রোগীর বেডসোর হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তির ওজন গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওজন ভারী বা কম যে কোনও ব্যক্তির সোর হতে পারে। বিশেষ ধরনের রিপল ম্যাট্রেসে রোগীকে শোয়ানো হয়।
* নড়াচড়া কম থাকায় ডিপ ভেন থ্রম্বোসিস প্রতিরোধের জন্য বিশেষ ধরনের স্টকিংস পরানো হয় রোগীকে।
* প্রয়োজন বিশেষে রোগীকে ব্লাড থিনার ওষুধ দেওয়া হয়। প্রতি মুহূর্তে রোগীর বিভিন্ন প্যারামিটারের উপরে নজর রাখতে হবে।
কোনও সংক্রমণ অবহেলা করার নয়। সেপসিস জীবননাশকারী। তাই সেই পর্যায়ে যাওয়ার আগে যত ভাবে সম্ভব, প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি।