Illness

Prosopagnosia: মুখ ঢেকে যায় প্রসোপ্যাগনোশিয়ায়

এই রোগের লক্ষণ পরিচিত মানুষদের মুখ দেখে চিনতে না পারা। কারও মুখ একবার দেখলে পরমুহূর্তে ভুলে যাওয়া। কী ভাবে রোগমুক্তি সম্ভব?

Advertisement

ঊর্মি নাথ 

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২২ ০৮:০৪
Share:

বেশ কিছুদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন বছর ৭৫-এর অমলবাবু, ব্রেন স্ট্রোক হওয়ার কারণে। অপারেশনের পরে জ্ঞান ফিরলে ঘরের বাইরে ছেলের গলা পেয়ে নার্সকে বলেছিলেন ছেলেকে ডেকে দিতে। ছেলে ঘরে ঢুকে বাবার সামনে দাঁড়ালে অমলবাবু ছেলের দিকে তাকিয়ে তাঁকেই বললেন, ‘‘আমার ছেলেকে একটু ডেকে দেবেন?’’ শুধু পুত্র নয়, পূর্ব পরিচিত কাউকেই, এমনকি স্ত্রীকে দেখে চিনতে পারেন না তিনি। গলার স্বর শুনে অবশ্য বুঝতে পারেন কে কোন জন।

Advertisement

চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে সন্ধেগুলো টিভিতে ধারাবাহিক দেখেই কাটত সীমার। সমস্যা শুরু হল গাড়ি দুর্ঘটনার পরে। প্রাণে বেঁচে গেলেও মাথায় আঘাত পান যথেষ্ট। তার পর থেকেই পরিচিতদের মুখ কিছুতেই মনে রাখতে পারেন না। তাই ইদানীং প্রিয় ধারাবাহিকগুলো দেখতে চান না। চরিত্রগুলো রোজই নতুন মনে হয়।

স্বভাবে শান্ত, পড়াশোনায় ভাল আট বছরের আকাশ। স্কুলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ আবৃত্তি করে প্রথম হয়েছে প্রতিযোগিতায়। কিন্তু এর পরেও তার কোনও বন্ধু নেই। তাকে কেউ খেলায় নেয় না, টিফিন খেতে ডাকে না। স্কুলে এলেই তার মনখারাপ হয়ে যায়, বন্ধুরা তাকে ‘ভুলো আকাশ’ বলে। সে রোজ বন্ধুদের মুখ দেখে কিন্তু কিছুতেই মনে রাখতে পারে না কোনটা ঋজু, কোনটা তমাল, কোনটা স্থিতপ্রজ্ঞ!

Advertisement

উপরোক্ত তিনজনের মধ্যে বয়সের পার্থক্য থাকলেও সমস্যা এক। এঁরা প্রত্যেকেই বিরল রোগ প্রসোপ্যাগনোশিয়ার শিকার। এই রোগের লক্ষণ পরিচিত মানুষদের মুখ দেখে চিনতে না পারা। কারও মুখ একবার দেখলে পরমুহূর্তেই ভুলে যাওয়া। এমনকি নিজের শৈশবের ছবি দেখে নিজেকে চিনতে না পারা! তাই প্রসোপ্যাগনোশিয়াকে ফেস ব্লাইন্ডনেসও বলে।

কেন হয় প্রসোপ্যাগনোশিয়া?

নিঃসন্দেহে প্রসোপ্যাগনোশিয়া ইউনিক ব্রেন প্রবলেম। আক্রান্তরা মুখ চিনতে না পারলেও, গলার আওয়াজ শুনে, স্পর্শ করে, পোশাক দেখে বা আরও অন্য কোনও উপায়ে চিনতে পারেন পরিচিত মানুষটিকে। পুরনো কথা মনে করতে অসুবিধে হয় না। শুধু মুখটাই মনে রাখতে পারেন না। এই অদ্ভুত সমস্যা কেন হয়? উত্তরে নিউরোলজিস্ট ডা. জয়ন্ত রায় বললেন, ‘‘আমরা যা দেখি সে হাতি, ঘোড়া, মানুষ, জড়বস্তু যা-ই হোক না কেন, তার একটা ছবি সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কে চলে যায়। বলা ভাল, একবার দেখার পরে তার ছাপ থেকে যায় মস্তিষ্কে। তাই কিছু দেখার পরে মস্তিষ্ক সেই ছবির সঙ্গে তার স্মৃতিতে থাকা ছবির কোনও মিল আছে কি না সেটা খোঁজে। ধরুন, মস্তিষ্কে একজনের মুখের ছবি পৌঁছল, সেটা সে মেলায় আগে দেখা মুখের স্মৃতিগুলো থেকে। মিল খুঁজে পেলে মনে পড়ে যায় মুখের নাম। এই ইনফরমেশন প্রসেসিং প্রসেসটা মস্তিস্কের যেখানে হয় তাকে বলে অ্যাসোসিয়েশন কর্টেক্স। সমস্যা হয় যখন এই কর্টেক্স বিকল হয়ে যায়। প্রসেস করতে না পারায় রাম-শ্যাম-যদু, সকলের মুখের মধ্যে কোনও তফাত করা যায় না। এক কথায়, প্রসোপ্যাগনোশিয়া হল অ্যাসোসিয়েশন কর্টেক্সের সমস্যা। দেখার অ্যাসোসিয়েশন কর্টেক্স যেমন আছে তেমন, শোনার, স্বাদের, স্পর্শেরও আলাদা আলাদা অ্যাসোসিয়েশন কর্টেক্স থাকে মস্তিষ্কে।’’

প্রসোপ্যাগনোশিয়া দু’ধরনের, অ্যাকোয়ার্ড এবং কনজেনিটাল। ব্রেন স্ট্রোক, ব্রেন টিউমার, দুর্ঘটনার জন্য মাথায় চোট, ট্রমা, অ্যালঝাইমার্স, এনকেফালাইটিস ইত্যাদির জন্য অ্যাসোসিয়েশন কর্টেক্স বিকল হয়ে প্রসোপ্যাগনোশিয়া হলে তাকে অ্যাকোয়ার্ড প্রসোপ্যাগনোশিয়া বলে। অন্য দিকে কনজেনিটাল প্রসোপ্যাগনোশিয়ায় জন্ম থেকেই অ্যাসোসিয়েশন কর্টেক্স কাজ করে না, ফলে মুখ দেখে চেনার কর্মকাণ্ড মস্তিষ্ক পরিচালনা করতে পারে না কখনওই।

কী করে বোঝা যাবে

বিরল রোগ হওয়ায় আর পাঁচটা রোগের মতো প্রসোপ্যাগনোশিয়া নিয়ে চর্চা নেই। তাই রোগটি সম্পর্কে অধিকাংশজনই অনভিজ্ঞ। এই কারণে বাড়ির লোক বুঝতে পারেন না, এমনকি রোগী নিজেও বুঝতে পারেন না সমস্যাটা কোথায়। বাড়ির লোক মনে করেন, হয়তো চোখের সমস্যার জন্য দেখতে পাচ্ছেন না। কারণ রোগী তো কণ্ঠস্বর শুনে বা অন্য ভাবে পরিচিতজনকে চিনতে পারছেন। বয়স্কদের ক্ষেত্রে অনেকেই একে ডিমেনশিয়ার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। তখন যদি পরীক্ষা করে দেখা যায় অন্য সব স্মৃতি ঠিক আছে, তা হলে সচেতন হতে হবে। কারণ ডিমেনশিয়া হলে অন্য স্মৃতিও নড়বড়ে হয়ে যায়। সমস্যাটি আঁচ করলে যেতে হবে নিউরোলজিস্টের কাছে। স্ক্যানিং, এমআরআই ইত্যাদি নানা পরীক্ষার পরে তাঁরা বুঝতে পারেন প্রসোপ্যাগনোশিয়া হয়েছে কি না।

চিকিৎসা

এই অসুখের আরোগ্য সম্ভব নয় বললেই চলে। ‘‘প্রসোপ্যাগনোশিয়া সারিয়ে দিতে পারে এমন কোনও ওষুধ নেই। কিছুটা ট্রেনিং দিয়ে বা জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে অবস্থার পরিবর্তন করা যায়। বিশেষ করে অ্যাকোয়ার্ড প্রসোপ্যাগনোশিয়া হলে যে কারণে হয়েছে সেই রোগ সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। কনজেনিটাল প্রসোপ্যাগনোশিয়া যেহেতু জন্মগত, ওতে বাচ্চারা বেশ সমস্যায় পড়ে। বিশেষ করে যখন স্কুলে যাচ্ছে, পাড়ায় মিশছে। আশপাশের ছোটরা বুঝতে না পেরে, তাকে নিয়ে মজা করে, এতে বাচ্চাটি বিপন্ন বোধ করে। এক্ষেত্রেবাবা-মাকে স্কুলের শিক্ষক থেকে পাড়া-প্রতিবেশী সকলকেই নিঃসঙ্কোচে জানাতে হবে সন্তানের সমস্যার কথা। যাতে তাঁরা বাচ্চাটির সঙ্গীদের বোঝাতে পারেন, তাকে উত্যক্ত না করে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করতে। শিশু হোক বা বয়স্ক,চিনতে না পারার সমস্যা থেকেমনের উপর চাপ পড়েই। তাই প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করাতে হবে,’’ বললেন ডা. রায়।

প্রসোপ্যাগনোশিয়া থেকে সম্পূর্ণ আরোগ্য পাওয়া যায় না ঠিকই, তবে কিছু পদ্ধতির মাধ্যমে জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক ছন্দে ফেরানো যায়। মুখ বাদ দিয়ে মানুষের চুলের কায়দা দেখে, উচ্চতা দেখে, কণ্ঠস্বর শুনে, পোশাক দেখে, ম্যানারিজ়ম থেকে, এমনকি স্পর্শের মাধ্যমে যাতে মানুষ চেনা যায়, তার ট্রেনিং করানো হয়। তাঁদের ভাল থাকা অনেকাংশে নির্ভর করে চারপাশের মানুষগুলির উপর। সন্তানের মুখ চিনতে না পারার সমস্যা হচ্ছে বুঝলে বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। বড় অসুখের পরে বয়স্কদের ক্ষেত্রে চেনার অসুবিধে হলে ‘বয়স হচ্ছে তাই স্মৃতি লোপ পাচ্ছে’ ভেবে নিয়ে সমস্যাটি এড়িয়ে যাবেন না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement