ঘরোয়া টোটকা থেকে চিকিৎসাশাস্ত্র, সেঁক দেওয়ার বিধান সর্বত্রই আছে। প্রশ্ন হল, কখন কোনটা দেবেন? আগেকার দিনে অনেক ব্যথাতেই গরম সেঁকের পরামর্শ দিতেন বাড়ির বড়রা। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষা বদলের ফলে এ কথাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, অল্প কয়েকটি বিষয় ছাড়া গরম সেঁকের কার্যকারিতা নেই। তবে বিষয়টি এখনও তর্কসাপেক্ষ। তাই জেনে নেওয়া যাক, কোন পরিস্থিতিতে কী করবেন।
কখন ঠান্ডা, কখন গরম
একটা সময়ে পা মচকে গেলে বা ভেঙে গেলে ঘরোয়া চিকিৎসায় গরম সেঁক দেওয়ার চল ছিল। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলছে। হাত-পা ভাঙলে বা মচকালে ভুলেও গরম সেঁক চলবে না। ‘‘ফ্র্যাকচার হওয়া মানে একটা ইন্টারনাল ব্লিডিং রয়েছে। সেখানে গরম সেঁক দিলে তা বেড়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে কোল্ড কমপ্রেস দিতে হবে। কোনও নতুন ইনজুরির ক্ষেত্রে সব সময়ে ঠান্ডা সেঁক দিতে হবে। পুরনো ব্যথার ক্ষেত্রে আরামের জন্য গরম সেঁক চলতে পারে। আগে জরুরি চিকিৎসকের পরামর্শ,’’ মন্তব্য সিনিয়র ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট সোনালি সেনগুপ্তর।
ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, ঘাড়ে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে কিংবা দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটারে কাজ করার ফলে ঘাড়ে, হাতে, আঙুলে ব্যথা বোধ করছেন— এ ক্ষেত্রে গরম সেঁক আরাম দেবে। সারাদিন হাঁটাহাঁটি বা দাঁড়িয়ে কাজ করলে, পায়ের মাসলে ব্যথা করে। তখন হালকা গরম জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকলে আরাম পাবেন। আর্থ্রাইটিস, জয়েন্ট পেন এই জাতীয় সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে গরম সেঁক চলতে পারে। একটি বিষয়ে সতর্ক করে দিচ্ছেন ফিজ়িয়োথেরাপিস্ট সোনালি সেনগুপ্ত, ‘‘ঘাড়ের ব্যথা এবং বাঁ হাতের ব্যথায় কখনওই ঠান্ডা সেঁক দেবেন না। এখানকার নার্ভ হার্টের সঙ্গে জড়িত। কারও যদি হার্টের সমস্যা থাকে, তা হলে ঠান্ডা সেঁকের ফল মারাত্মক হতে পারে। এ কারণেই চিকিৎসকের পরামর্শ আগে জরুরি।’’ অর্থোপেডিক সার্জারির পরে আইস কমপ্রেসের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। আবার গাইনিকলজিক্যাল বা মেনস্ট্রুয়াল পেনের সময়ে হট ব্যাগ দেওয়া যেতে পারে।
এ ক্ষেত্রে মাথায় রাখবেন, ঠান্ডা বা গরম সেঁক কিন্তু আসল সমস্যার সমাধান নয়। জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডাক্তার সুবীর মণ্ডলের কথায়, ‘‘এটি মানসিক শান্তি ছাড়া আর কিছু নয়। ইন্টারনাল সমস্যায় এক্সটারনাল থেরাপি কাজ করে না। হ্যাঁ, সেঁকের ফলে নার্ভগুলো স্টিমুলেটেড হয়ে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে বড়জোর।’’
কী ভাবে দেবেন
আইস প্যাক জেল ফরম্যাটে ওষুধের দোকানে কিনতে পাওয়া যায়। বাড়িতে ফার্স্ট-এড হিসেবে এটি অবশ্যই রাখা উচিত। আইস প্যাকের কাজ কিন্তু বরফ দিয়ে হবে না। তাপমাত্রার তারতম্য হয়ে যায়। ইনজুরির জায়গা বেশিক্ষণ আইস প্যাক দিয়ে চেপে রাখবেন না। প্যাকটা ধীরে ধীরে বোলাতে হবে।
গরম সেঁকের ক্ষেত্রে বাজার চলতি হিট প্যাড ব্যবহার করতে বারণ করেন চিকিৎসকেরা। এগুলো বেশি দিন ব্যবহার করলে চামড়ার উপরে প্রভাব ফেলবে। গরম সেঁকে তোয়ালে দিয়ে মুড়ে হট ওয়াটার ব্যাগ ব্যথার জায়গায় দিতে পারেন। হাত বা পায়ের ব্যথায় ঈষদুষ্ণ জলে ডুবিয়ে রাখলে আরাম হবে।
কিছু ভ্রান্ত ধারণা
অনেকে ভাবেন, আইস প্যাক দিলে জ্বর আসবে। এটা ভিত্তিহীন। সেঁক শুধুমাত্র সমস্যার জায়গার মাসলগুলোকে রিল্যাক্স করে দিচ্ছে।
ফোঁড়া হলে বা পুঁজ জমে গেলে অনেকে গরম সেঁক দেওয়ার কথা বলেন। ডা. সুবীর মণ্ডলের কথায়, ‘‘ফোঁড়ায় সেঁক দেওয়াটা ভুল। সেঁক দিয়ে ফাটিয়ে পুঁজ বার করে দিলেও ভিতরে জীবাণু থেকে যাবে, তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকই সমাধান। তবে ফোঁড়া একেবারে পেকে সাদা হয়ে থাকলে গরম সেঁক দেওয়া যায়। কিন্তু শুরুতেই সমাধান করা উচিত। আমরা ওষুধ দিয়ে জিনিসটাকে বসিয়ে দিই, তাতে ভিতরের জীবাণুটাও নষ্ট হয়ে যায়।’’ বাচ্চাদের কান ফুটিয়ে আনার পরে ব্যথা হলেও সেঁকের বদলে অয়েন্টমেন্ট লাগানোর পরামর্শ তাঁর।
সব শেষে এটা মাথায় রাখবেন, ঠান্ডা বা গরম যে সেঁকই দেওয়া হোক না কেন, তা সাময়িক আরাম দিতে পারে, সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।
দীপান্বিতা মুখোপাধ্যায় ঘোষ