খসখসের পর্দা কি এখনও পাওয়া যায় কলকাতায়? ছবি: সংগৃহীত।
গত কিছু বছর যাবৎ শহরে গরম পড়ছে তীব্র। এই বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। কালবৈশাখীর দেখা মেলেনি প্রায়। বৃষ্টিও হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। শেষ তিন দশকে শহরের তাপমাত্রা বেড়েছে চড়চড়িয়ে। আর এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ঘর ঠান্ডা রাখার উপকরণের চাহিদা।
গরম মোকাবিলায় এসির চাহিদা অত্যন্ত বেশি হলেও এখন পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে অনেকটা। পৃথিবী জোড়া উষ্ণায়নে এসিতে ব্যবহৃত হাইড্রোফ্লুরোকার্বন গ্যাসের অবদান কম নয়। তাই এসির বিকল্প নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে বহু দিন ধরেই। আর এই সূত্র ধরেই উঠে আসছে ঘর ঠান্ডা রাখার প্রাকৃতিক উপায় খসখসের নাম। ঘাসের শিকড় দিয়ে তৈরি খসখসের পর্দা ভিজিয়ে ঘরে টাঙিয়ে রাখলে নিমেষে ঠান্ডা হয় ঘর।
যখন কোনও শীতাতপ নিয়ন্ত্রণকারী যন্ত্রের এত রমরমা ছিল না, সেই সময়ে কলকাতায় খসখসের বহুল ব্যবহার ছিল। কলকাতার দীন রক্ষিত লেনের বাসিন্দা অমৃতলাল দাঁর বাড়ির বয়স দুশো বছর। বাড়ির সদস্য ষাটোর্ধ্ব অমরনাথ দাঁ বললেন, ‘‘ছোটবেলায় বাড়িতে খসখসের পর্দা টাঙিয়ে রাখা হত গরম থেকে বাঁচতে। পুরনো বাড়ির মোটা দেওয়াল যে তাপ আটকাতে পারত না, তা অনায়াসে আটকে দিত ঘাসের শিকড়ের পর্দা। শৈশবে গাড়ি করে সপরিবার চাঁদনি মার্কেটে যাওয়া হত এটি কিনতে। গরমে খসখসে জল দেওয়া হত পিচকিরি দিয়ে। বাড়ির ভৃত্যদের জন্য এই কাজ নির্দিষ্ট থাকলেও শিশুরা এসে হাত লাগাত জল নিয়ে হুটোপাটি করার লোভে। গরম চলে গেলে কীটনাশক দিয়ে পর্দা গুটিয়ে রাখা হত। প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতা হুগলির আঢ্য বাড়ির মেয়ে পৌলোমী আঢ্যর। বয়সে তরুণী পৌলোমীও ছোটবেলায় তাঁর শতাব্দী প্রাচীন বাড়িতে খসখসের ব্যবহার দেখেছেন। তাঁদের কলকাতার বাড়িতেও এসি আসার আগে পর্যন্ত এর ব্যবহার ছিল। আর হুগলির বাড়ির খসখস অন্য ভূমিকাও পালন করত। দুর্গা পুজোর সময়ে বাড়িতে যখন বিস্তর জনসমাগম হত, তখন পর্দার কাজ করত এটি। অলিন্দ খসখসে মোড়া থাকায় বাড়ির মহিলারা যখন সেখানে হাঁটতেন, বাইরে থেকে দেখা যেত না তাঁদের। এই জন্যই গরমের পর গুটিয়ে রাখা খসখস খুলে দেওয়া হত পুজোর কটা দিনের জন্য।
খসখসের ব্যবহার কিন্তু বহু প্রাচীন। গরম দূর করার প্রাকৃতিক উপায় হিসাবে আবুল ফজলের লেখা ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বাদশাহেরা দারুণ গরমে খসখসের পর্দা দিয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়া উপভোগ করতেন প্রাণ ভরে। সেই সময়ে বাড়িতে মাটির পাত্রে জল রেখে তার মধ্যে দিয়ে দেওয়া হত খসের শিকড়। এতে জল ঠান্ডা থাকত। এই ঘাস দিয়ে বানানো হত বিশেষ এক ধরনের শরবত। জাহানারা নামে এই পানীয়ের মূল উপাদান ছিল লেবু, লঙ্কা খসের নির্যাস আর বরফ। এখনও পুরনো দিল্লিতে এই শরবত পাওয়া যায়। খস থেকে যে আতর বানানো হত, তার চাহিদা ছিল তুমুল।
খসখসের ব্যবহার কিন্তু বহু প্রাচীন। ছবি: সংগৃহীত।
যদিও এরও অনেক আগে বেদে ওষধি রূপে খসখসের ব্যবহারের কথা পাওয়া যায়। প্রবল গরমে পিত্তদোষে ভুগতেন যাঁরা, তাঁদের জন্য এই ঘাসের থেকে আসা ওষুধ কাজে দিত। খসখসের নির্যাস ঠান্ডা করত শরীর আর মন। এর থেকে যে তেল পাওয়া যেত, তা রাগ প্রশমিত করার ক্ষেত্রে অব্যর্থ ছিল। সেই সঙ্গে ছিল রোদে পোড়া ত্বক ঠিক করতে এর অসাধারণ ভূমিকা। খসখসের তেল আর রোজ়উডের তেলের মিশ্রণ ব্যবহার করা হত মানসিক চাপ কমাতে। পঞ্চদশ শতকে লেখা জয়দত্তের বই অশ্ববৈদকে বলা হয়েছে সুগন্ধি খস ঘাসের ঘ্রাণ দুরন্ত অশ্বকে বাগ মানায়। পশুপালনে খসের আরও উপকারের কথা বলা হয়েছে বইটিতে।
ইংরেজরা এ দেশে আসার পর প্রবল গরমে যখন নাজেহাল হতেন, তখন খসখস খানিক স্বস্তি দিত তাঁদের। ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত ‘দ্য কমপ্লিট হাউজ় কিপার অ্যান্ড কুক’ বইয়ে ফ্লোরা অ্যানি স্টিল এবং গ্রেস গার্ডিনার গরমে খসখসের উপযোগিতার কথা বলেছেন। লেখিকাদ্বয় বলেন থারম্যান্টিডোটের কথা। তাঁদের মনে হয়েছিল, উত্তর ভারতে এই জিনিস অপরিহার্য। এই যন্ত্রের মধ্যে ছিল ফ্যান আর দু’দিকে দু’টি খসখস। এগুলিকে জল দিয়ে ক্রমাগত ভিজিয়ে রাখতে হত। কুলি বা খিদমতগারেরা খসখস ভিজিয়ে রাখার দায়িত্বে ছিলেন। এর ফলে ঘরের তাপমাত্রা অন্তত ১০ ডিগ্রি কম হয়ে যেত। এটা এতটাই কাজের ছিল যে, লেখিকার বিরাট এক ঘর তিনটি থারম্যান্টিডোট দিয়ে ঠান্ডা করার পর আশপাশের বাড়ির অনেকেই এসে দুপুরে সেখানে আশ্রয় নিতেন। অ্যানি স্টিলের মতে টানা পাখার থেকে খসখস অনেক বেশি উপযোগী ছিল, কারণ পাখা টানতে গিয়ে প্রায়ই ভৃত্যদের চোখ লেগে আসত। তবে খসখসের অসুবিধার কথাও উল্লেখ করেছেন লেখিকা। এর থেকে আসা বাতাস ভেজা হাওয়ায় প্রায়ই শরীর খারাপ জ্বরজারি হত। কিন্তু প্রচণ্ড গরমে শান্তিতে একটু ঘুমোনোর জন্য সেই কষ্টটুকু সহ্য করাই যায়, বলেছেন তিনি। শুধু ঘর নয়, আস্তাবলের গরম কম করার জন্যও সংলগ্ন বারান্দায় ঘাসের চিক টাঙিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অ্যানি।
গড়িয়াহাটে, দক্ষিণাপণের কিছু দোকানে, যোধপুর পার্ক সংলগ্ন অঞ্চলের কিছু দোকানে খসখস পাওয়া যায় এখনও। ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডে সিরাজ খানের প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো দোকান ‘ক্যালকাটা খস খস’। তিনি বলেন, ‘‘আগে কলকাতার ধনী বাড়িগুলিতে এই জিনিসের ব্যবহার ছিল। প্রতি বছর গরমের আগে বিপুল অর্ডার আসত এর। এখন আর সে দিন নেই। খসখস এনে পড়ে থাকে দোকানে।’’ গলা থেকে আক্ষেপ ঝরে পড়ল তাঁর। ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, ‘‘আগে ক্রেতার ভিড়ে গরমের সময়টা শ্বাস ফেলার অবকাশ থাকত না। কিন্তু এখন ক্রেতাই থাকে না।’’ অন্য ব্যবসাতেও মন বসেনি তাঁর। এখন সংসার চালানোই দায়। একই কথা বললেন গড়িয়াহাট থানা সংলগ্ন দোকানের এক খসখস বিক্রেতা জাহির খান। তিনি জানালেন, চেন্নাই থেকে খসখস আসে প্রতি বছর। এ বার চাহিদার অভাবে জিনিসই এসে পৌঁছয়নি কলকাতায়। মশারির নেট, আরও হাবিজাবি দিয়ে দোকান সাজিয়েছেন তিনি। বাড়িতে সদস্য অনেক। এখন পেট চলাই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ কলকাতার যোধপুর পার্ক সংলগ্ন পোদ্দার নগরের বি এস ফার্নিশং নামে এক দোকানের মালিক গঙ্গা শর্মা কিন্তু জানালেন, তাঁর দোকানে চলতি বছরে খসখসের বিক্রি এতই ভাল যে, জোগান দিয়ে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। এই দোকানে খসখসের দাম ১০৪ থেকে ১০৮ টাকা স্কোয়ার ফুট। বিক্রিবাটায় খুশি গঙ্গার গলায় স্বস্তি। তিনি জানালেন, খসখসের খদ্দের এখনও কম নয় শহরে। কলকাতার সরকারি হাসপাতাল, কিছু অফিস থেকে শুরু করে চিড়িয়াখানার পশুপাখিদেরও গরমে স্বস্তি দিতে কাজে লাগছে খসখস। খোলা জায়গায় যেখানে এসি ব্যবহার করা যাচ্ছে না, সেই জায়গার জন্য এই জিনিস নিচ্ছেন অনেকেই। বেশ কিছু বাড়িতে নির্দিষ্ট কিছু ঘরের জন্য খসখস কিনেছেন বাড়ির মালিক। যাঁদের এসি কেনার মতো সঙ্গতি নেই, তাঁরাও চলতি বছরের প্রচণ্ড গরমে ঢালাও কিনেছেন খসখস।
আজকাল অনলাইনেও পাওয়া যায় খসখস। অ্যামাজ়নে অর্ডার দিলে কিছু দিনেই এই জিনিস হাজির হবে বাড়িতে। ছ’ফুট লম্বা আর তিন ফুট চওড়া খসখসের দাম পড়ছে মোটামুটি দেড় হাজার টাকা।
গরমের শুরুতে অনলাইনে খসখস কিনেছেন বাঙুরের বাসিন্দা মুকুন্দ আগরওয়াল। কিছু বছর আগেও বাঙুর স্টেট ব্যাঙ্কে খসখসের বিরাট পর্দা ঝোলানো দেখতেন তিনি। দারুণ গরম থেকে ভিতরে এসে এর সামনে দাঁড়িয়ে জুড়োতেন খানিক ক্ষণ। ব্যাঙ্কে এসি এসে গিয়েছে বহু দিন। তুলে দেওয়া হয়েছে পর্দা। এ বার নিজে খসখস ব্যবহার করে রীতিমতো খুশি। তিনি বলেন, ‘‘ঘরে খসখস ভিজিয়ে টাঙিয়ে দিলে অদ্ভুত সুন্দর গন্ধে ঘর ভরে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে হাওয়া আসছে ভেজা আমেজ নিয়ে।’’ এই ভেজা হাওয়া নিয়েই অবশ্য আপত্তি পাটুলির বাসিন্দা অমৃতা দত্তের। গত বছর খসখস কিনেছেন তিনি। অসন্তুষ্ট গলায় বললেন, ‘‘খসখসের হাওয়া অস্বাস্থ্যকর। ক্রমাগত ভেজা হাওয়া সর্দি কাশির কারণ হচ্ছে তো বটেই সেই সঙ্গে বাড়াচ্ছে বাতের ব্যথাও।’’ খসখস ক্রমাগত ভিজিয়ে রাখার নিয়মও অসুবিধাজনক লাগছে তাঁর। খসখস নিয়ে নানা কথার শেষে একটু হেসে বললেন, ‘‘আমার বাবা এসিই ভাল লাগে বেশি। নতুন বাড়ির টানা বারান্দার জন্য খসখস রেখে ঘরে এসি বসিয়ে নেব।’’
এয়ারকন্ডিশনার বা কুলারের থেকে অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব খসখস। ছবি: সংগৃহীত।
এয়ারকন্ডিশনার বা কুলারের থেকে অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব খসখস। এই দু’য়ের থেকে দামেও বেশ কিছুটা কম। খসখস ঘর তো ঠান্ডা করেই, তা ছাড়াও বেশ কিছু উপযোগিতা আছে এই জিনিসের। শুধু গরম নয়, অন্যান্য সময় রোদও আটকায় এই জিনিস। পোকামাকড় ঘরে ঢুকতে দেয় না। খসখস বেয়ে হাওয়া ঘরে ঢুকলে এর নিজস্ব সুগন্ধে ভরে যায় ঘর।
ফরাসি পর্যটক এবং চিকিৎসক বার্নিয়ে ১৬৬৫-তে কাশ-কন্যা নামে এক ধরনের ছোট বাড়ির কথা বলেছেন, যা ভারতের ভয়াবহ গরমে খানিক স্বস্তি দিত। এই ঘর খড় অথবা সুগন্ধি শিকড় দিয়ে তৈরি। নিকটবর্তী জলাশয় থেকে জল এনে এর গা ভিজিয়ে ভৃত্যেরা নিয়ত এই ঘরটিকে ঠান্ডা রাখত। এই শিকড় সম্ভবত খসখস। মোগল আমলের মতো এমন বাড়ি এখন আর সম্ভব নয়। তবে খসখসের দৌলতে এমন একটি ঘর সম্ভব, প্রখর তাপে যা ছায়া দিয়ে, সুগন্ধ দিয়ে জড়িয়ে রাখবে।