পিছওয়াই পেন্টিং। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
শিল্পচর্চা যেন এক নিরন্তর সাধনা। আর ভারতীয় শিল্পকলায় নানা পৌরাণিক চরিত্র উঠে এসেছে বরাবর। যেমন আমাদের বাংলার পটচিত্রে শিব-পার্বতী, গণেশ, লক্ষ্মীর পাশাপাশি মনসা, বনবিবির মতো লোকদেবী ও লোককথা উঠে আসে, ওড়িশার পটচিত্রে দশাবতার, জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামের ছবি যেমন প্রাধান্য পেয়ে এসেছে, ঠিক সে ভাবেই পিছওয়াই শিল্পে আবার উঠে আসে কৃষ্ণের লীলা। তবে এই চিত্রকলায় কৃষ্ণ ধরা দিয়েছেন শ্রীনাথজির রূপে। তার সঙ্গী দুধেল গাই, গোপিনী, কুঞ্জবনই তাই এই শিল্পের আধার।
পিছওয়াইয়ের প্রেক্ষাপট
প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো এই শিল্পের নিদর্শন পাওয়া যায় রাজস্থানের নাথদ্বারা মন্দিরে। ১৬৭২ সাল নাগাদ নির্মিত এই মন্দিরে মূর্তির পিছনের চালচিত্রের মতো কাপড়ের উপরে এই ধরনের কাজ দেখা যায়। পিছওয়াই শব্দটিকে ভাঙলে ‘পিছ’ শব্দের অর্থ পিছনে ‘ওয়াই’ মানে ঝুলন্ত, অর্থাৎ কোনও ছবি বা মূর্তির পশ্চাদপটে সুন্দর দৃশ্যনির্মাণের উদ্দেশ্যেই এই চিত্রকলার জন্ম। এই শিল্পস্রষ্টাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না গেলেও শোনা যায়, উদয়পুরের আদি গোর, জয়পুর-জোধপুর থেকে আগত জাঙ্গির ও মেওয়ারদের হাতেই এই শিল্পচর্চা শুরু হয়।
রঙের ব্যবহার, মোটিফে বৈচিত্র
এখন পিছওয়াই পেন্টিং কাগজের উপরে কৃত্রিম রং-তুলি দিয়ে হলেও আদিতে গেলে জানা যায়, মূলত মাড় দেওয়া সুতির কাপড়ের উপরেই এই ছবি আঁকা হত। কাপড় তৈরি করে ভাল করে শুকিয়ে লম্বায় টানটান করে বেঁধে দেওয়া হত। তার উপরে প্রথমে কাঠকয়লার গুঁড়ো দিয়ে শিল্পীরা ছবির নকশা করে নিতেন। এর পরে নারকেলের মালায় তৈরি হত ভেষজ রং। পিছওয়াইতে ধাতব রঙের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। সেই সোনালি, রুপোলি রঙের জন্য ধাতুর গুঁড়োও ব্যবহার করা হত রং তৈরিতে। জ়িঙ্ক, ইন্ডিগো থেকেও রং আহরণ করা হত। কেশর থেকে তৈরি হত গেরুয়া। ঘোড়ার লেজ বা চুল থেকে তৈরি তুলি সেই রঙে ডুবিয়ে চলত আঁকা।
পিছওয়াই পেন্টিংয়ের মোটিফেও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সাধারণত পদ্ম, ফুল-পাতার মোটিফ বেশি দেখা যায়। আর ছবির অবয়বের চোখ হবে টানা-টানা আধবোজা। মোটিফ ও ছবির বিষয়বস্তু অনুযায়ী ছবির নামকরণও করা হয়। যেমন ফুলের প্রেক্ষাপটে সাদা দুধেল গাইয়ের যে বহুল প্রচলিত ছবি পিছওয়াইয়ে দেখা যায়, তার নাম ‘কামধেনু’। আবার উৎসব অনুযায়ী রাসলীলা, হোলি, অন্নকূট ইত্যাদি বিষয়ের উপরেও পিছওয়াই অঙ্কন দেখা যায়। তবে পিছওয়াইয়ের একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নির্দিষ্ট কিছু ছবি ঘিরে ২৪টি খোপ আঁকা হয়। প্রত্যেকটির মধ্যে শ্রীনাথজির বিভিন্ন রূপ আঁকা থাকে, এদের বলা হয় স্বরূপ। এই রকম ধারা আবার দেখা যায় ওড়িশার পটচিত্রেও। সেখানে অবশ্য দশাবতারের রূপই স্থান করে নেয় এই খোপগুলোয়।
আবহমান ও আধুনিক
অন্যান্য পটচিত্রের মতোই এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে এই শিল্পকলার চর্চা চলে আসছে। তবে ‘পিছওয়াই’ শিল্প ধরা আছে গুরু-শিষ্য পরম্পরায়। অনেক সময়েই দেখা যায়, একই বংশ বা নির্দিষ্ট কোনও গ্রামের মানুষের মধ্যে স্থানীয় শিল্পের চর্চা সীমিত থাকে। কিন্তু ইদানিং ‘পিছওয়াই’ শিল্পের জনপ্রিয়তার কারণ তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে সাধারণের মধ্যে। তার জন্য এই শিল্পের ধারায় বদলও এসেছে অনেক। আগেকার দিনে প্রাকৃতিক উপায়ে যে ভাবে রং তৈরি হত, তা ইদানিং পাল্টেছে। ধাতব রঙের এই পরিমাণ জোগান দেওয়া এখন সম্ভব নয়। তাই অনেক কৃত্রিম রঙের ব্যবহারও বেড়েছে এই শিল্পে। তবে মূল ধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখে এখনও পিছওয়াই শিল্পে হলুদ, তুঁতে, লাল, সোনালি রঙের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। তবে আধুনিক ও পুরনো পিছওয়াই পেন্টিং লক্ষ্য করলে এই পার্থক্য চোখে পড়ে। আধুনিক আঁকাগুলো অনেক উজ্জ্বল, কিন্তু পুরনো চিত্রকলায় ভেষজ রঙের আর্দিনেস ধরা পড়ে।
তবে এখন শুধুমাত্র পেন্টিংয়েই আটকে নেই এই শিল্পকলা। পিছওয়াই শিল্পের মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে কাপ, কফি মাগ থেকে শুরু করে ট্রে, বাটি, চামচ ইত্যাদি বাসনপত্রে। কখনও আবার আসবাবের গায়ের একটা অংশেও এই মোটিফের টাইল জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। কাপড়ের উপরেই যেহেতু এই শিল্পের জন্ম এখন বহু শিল্পী শাড়ি ও ওড়নায় এই চিত্রকলা ফুটিয়ে তুলছেন। শাড়ির জমিতে হয়তো ছোট ফুল-পাতার নকশা থাকছে। পাড় বরাবর চলছে কৃষ্ণ-কাহিনি বা আঁচলের জমি জুড়ে থাকছে কৃষ্ণজীবনের কোনও বিশেষ অধ্যায়।
রাজস্থানের একটা ছোট্ট গ্রাম থেকে যে শিল্পের উত্থান, তা ক্রমশ বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিচ্ছে স্থানীয় শিল্পীদের কাজ। দেশজ রঙের আভিজাত্য, সূক্ষ্ম রেখায় তা জায়গা করে নিচ্ছে বৃহত্তর মানচিত্রে।
পিছওয়াই আর্ট সৌজন্যে: কেসিসি গ্যালারি স্টোর