প্রতীকী ছবি।
আট বছরের কুকি অনলাইন ক্লাসে শীতের ছুটিতে লাক্ষাদ্বীপ ঘুরে আসার মিথ্যে গল্প শুনিয়েছে।
কুশ ফোরে পড়ে। সে নাকি দাদাকে জিজ্ঞেস করেছে, গার্লফ্রেন্ডের জন্মদিনে কী উপহার দেওয়া যায়।
এ সব শুনে ধারণা হতে পারে, আট-দশ বছর বয়সের বাচ্চাদের মনোজগৎটা সময়ের আগেই বদলে যাচ্ছে। অনেক মা-বাবাই বলেন, কৈশোর আসার আগেই বাচ্চাদের রাগ-অভিমান, ইচ্ছে-আবদারের ধরন দেখলে অবাক লাগে। মনে হয় যেন টিনএজার! তবে বিষয়টা একটু অন্য রকম। যেমন, পরবর্তীতে জানা গিয়েছে, প্রতি বার ছুটির পরে কুকিদের ক্লাসটিচার প্রশ্ন করেন, কে কোথায় ঘুরতে গিয়েছিল। নানা পারিবারিক সমস্যার কারণে লকডাউনের আগে বেশ কয়েক মাস কুকিরা বেড়াতে যায়নি। বন্ধুমহলে মান রাখার তাগিদে বেচারি এমনটা করেছে। কুশের মা-ও জেনেছিলেন, সে প্রেম, ভাল লাগা নিয়ে স্পষ্ট কিছুই বোঝে না। গত বছর স্কুলের স্পোর্টসে সিনিয়র দাদাদিদিদের দেখাদেখি নিজের বন্ধুবৃত্তে তাদের অনুকরণের চেষ্টায় ছিল।
প্রি-টিনএজারদের (৮-১২ বছর) ভাবনা-চিন্তায়, আচার-আচরণে এমন অবাক হওয়ার ঘটনা এখন ঘরে ঘরে। মা-বাবাদের প্রশ্ন, সত্যিই কি ওদের মন এখন একটু আগেভাগেই পরিণত হচ্ছে বা বদলে যাচ্ছে? এই বয়সেই ভয়, টেনশন, স্ট্রেসের নানা লক্ষণই বা কেন ফুটে উঠছে ওদের মধ্যে? এ সব ক্ষেত্রে কী করবেন অভিভাবকেরা?
জানছে অনেক, বুঝছে কি?
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা একমত, বাচ্চাদের মনের বয়ঃসন্ধি মোটেও এগিয়ে আসেনি। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আবির মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘আসলে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা এখন মানসিক ভাবে অনেকটা আলাদা হয়েছে। ওদের কাছে তথ্য অনেক বেশি। ইন্টারনেটে সার্চ করেও অনেক জানতে পারে। কিন্তু সেটা কতটা আর কী ভাবে মনে রাখছে, আদৌ মাথায় ঢুকছে কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। এত বেশি তথ্য ওদের নাগালে, সেটা যাতে ঠিক ভাবে ওরা আত্তীকরণ করতে পারে, সে বিষয়টা বড়দেরই দেখা উচিত।’’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়রঞ্জন রাম বললেন, ‘‘তথ্য আর জ্ঞানের মধ্যে কিন্তু তফাত আছে। বাচ্চাদের কাছে এখন তথ্য অনেক। সেটা দেখে বাবা-মায়েরা মনে করেন, এরা বুঝি খুব বুঝদার হয়ে গিয়েছে। এই ধারণাটাও কিন্তু ভাঙতে হবে। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যে পরিণতি বা জ্ঞান আসে, সেটা ওরা কোথায় পাবে? সেই সাহায্যটা কিন্তু বড়দেরই করতে হবে। বাচ্চারা বলতে পারে, ‘ধুৎ! তুমি কিছু জানো না।’ তাকে বোঝাতে হবে, জাগতিক জ্ঞান তার নেই। ‘সেটা তোমাকে আমরাই হাত ধরে শেখাব।’ আর আলাদা করে বাচ্চাদের জীবনে স্ট্রেস, টেনশনের প্রভাব বাড়ছে, তাও কিন্তু নয়। জীবনযাত্রার ধরন বদলেছে। প্রি-টিনএজার, টিনএজার, যুবক-যুবতী, বয়স্ক মানুষ— প্রত্যেকের জীবনেই এখন দুশ্চিন্তা, অশান্তি বাড়ছে। মা-বাবার অগোচরে বন্ধুমহল থেকে বাচ্চাদের স্ট্রেস, টেনশন, অ্যাংজ়াইটি, আচরণগত সমস্যা দেখা দিতে পারে! হয়তো বাবা-মা বাচ্চার কাছ থেকে কিছু দাবি করেননি, কিন্তু বন্ধুবান্ধবের দেখাদেখি বাচ্চারা নিজেরাই নিজের উপরে চাপ তৈরি করে ফেলছে। পড়াশোনায় ভাল ফল করা, ভাল থাকা ইত্যাদি নিয়ে ওদের নিজেদের মধ্যেই কিন্তু প্রতিযোগিতার মনোভাব থাকে। অনেক সময়েই সমস্যার সূত্রপাত হয় সেখানেই।’’
বন্ধু নয়, সহমর্মী হোন
বাচ্চার মনের ভাব, তার পৃথিবীটাকে বোঝার চেষ্টা করুন। তবে তার জন্য বাবা-মায়ের জোর করে তার বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করার দরকার নেই। আবার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলেও চলবে না। এতে বাচ্চা ভয় পাবে। মিথ্যা বলবে, লুকোতে শিখবে। বরং সংবেদনশীল ও সহমর্মী হয়ে তাকে পথ দেখান। বিভিন্ন বিষয়ে তাকে উৎসাহ দিন, কোনও কিছুতে দমিয়ে দেবেন না। আবার কোনটা ন্যায্য সেটাও বুঝিয়ে বলুন। তার সঙ্গে কিছু কমন ইন্টারেস্ট শেয়ার করুন। তা হলে, ওর নিজের জগতে কী হচ্ছে সে বিষয়ে জানতে পারবেন। ও কোনও সমস্যায় পড়লে বা কোথাও অসুবিধে হলে আপনাকে বলতে পারবে। ডা. রামের পরামর্শ, যে বিষয়ে সন্তানের ঝোঁক রয়েছে, সে বিষয়ে আপনিও আগ্রহী হোন, খবর রাখুন। সন্তানের সঙ্গে জেনারেশন গ্যাপ-এর সমস্যা মিটবে। ডা. মুখোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বাচ্চা অতিরিক্ত চাপে রয়েছে কি না, সে দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। তার জন্য দুটো টিউশন কম পড়ালেও ক্ষতি নেই। কিন্তু ওর সার্বিক গঠনের কথা ভাবতে হবে। তাই পড়া ছাড়াও এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির সময় বার করতে হবে। নইলে অতিরিক্ত চাপের বোঝায় ও মুখ থুবড়ে পড়বে। খিটখিটে ভাব, অ্যাংজ়াইটি দেখা দেবে। গ্রেড কমবে।
বাচ্চাকে ভাল করে বোঝার সেরা উপায় তার বন্ধুদের ও তাদের পরিবারকে চেনা-জানা। তার জন্য এখন সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্য
নিতে পারেন।
ডা. মুখোপাধ্যায়ের মত, ‘‘কোনও বিশেষ কৌতূহল বা আচরণ লক্ষ করলে বকুনি দিয়ে ধামাচাপা দেবেন না। মেয়েদের সম্মান করতে শেখান বাচ্চা ছেলেদের। ও নিজে থেকে জানার চেষ্টা করার আগেই ওর বয়সের মতো করে যৌন শিক্ষা দিতে শুরু করুন। বিপথে যাওয়ার বা বিপদে পড়ার আশঙ্কা কমবে।’’ জীবনের জরুরি শিক্ষাগুলো দিন গল্পের মাধ্যমে। ডা. রাম বললেন, ‘‘ইমোশনাল অ্যাবিউজ়, নেট দুনিয়ার ট্রোলিং, অনলাইন বা সহপাঠীদের বুলিং কিংবা যৌন শোষণ হলে বাচ্চারা কিন্তু বলতে পারে না। তাকে বোঝান, যদি এমন কিছু হয়, নির্দ্বিধায় তা বলতে।’’
এই বয়সের শিশুরা আস্তে আস্তে পৃথিবীকে চিনতে শুরু করছে। ও ঠোক্কর খাবে, ভুল করবে, তার থেকেই শিখবে। এমন পরিবেশ তৈরি করুন, যাতে ভুল করলে ও আপনাকে এসে বলতে পারে, হাত বাড়ালে আপনাকে পাশে পায়। আপনি ওকে আগলে রাখুন, আটকে নয়।
চিরশ্রী মজুমদার