—প্রতীকী চিত্র।
দৃশ্য ১: বছর সতেরোর কিশোরী মালবিকা। প্রথমে মিষ্টি, চকলেট বাদ। পরে মাছ-মাংস, ভাত-রুটি, সবেতেই কোপ।
দৃশ্য ২: বছর ৩৫-এর সৌভিক আবার অনুষ্ঠান বাড়িতেও সঙ্গে নিয়ে যান পছন্দ মতো ‘স্বাস্থ্যকর’ খাবার।
স্বাস্থ্যসম্মত খাওয়া জরুরি। জরুরি খাদ্যাভ্যাসে নিয়ন্ত্রণও। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ যদি মালবিকা বা সৌভিকদের মতো মাত্রাতিরিক্ত হয়ে ওঠে, তবেই দেখা দেয় বিপত্তি। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এই বিপত্তির নেপথ্যে রয়েছে স্বাস্থ্যকর খাওয়া নিয়ে অতিরিক্ত উদ্বেগ। আর সেটা এতটাই যে, বিঘ্নিত হয় মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য। আসলে এটাই ‘অর্থোরেক্সিয়া নার্ভোসা’ নামে এক ধরনের খাদ্যাভ্যাসের ব্যাধি (ইটিং ডিজ়অর্ডার)।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জয়রঞ্জন রাম বললেন, “অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা, বুলিমিয়ার মতো বেশ কিছু ইটিং ডিজ়অর্ডারের সঙ্গে আমরা কিছুটা পরিচিত হলেও অর্থোরেক্সিয়া নার্ভোসার বিষয়ে অনেকেই অবগত নই। আবার, স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়া নিয়ে বেশি চিন্তা করা বা পছন্দের ‘পুষ্টিকর’ খাবারটাই সবসময়ে বেছে নেওয়া, এটাও যে কোনও ‘ব্যাধি’ হতে পারে, তা মানতে চান না অনেকে। এতেই পরবর্তীতে সমস্যা দেখা দেয়। বস্তুত, ১৯৯৭ সালে স্টিভ ব্র্যাটম্যান নামে ক্যালিফোর্নিয়ার এক চিকিৎসক এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন। বিশ্বের নানা প্রান্তে বেশ চর্চায় রয়েছে বিষয়টি।”
যাঁদের হতে পারে
নানা পারিবারিক বা মানসিক কারণে অর্থোরেক্সিয়ার শিকার হতে পারেন। বিশেষজ্ঞদের মতে,
কোনও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যদি কোনও সময়ে ইটিং ডিজ়অর্ডারের শিকার হন বা তাঁদের যদি অতিরিক্ত ডায়েট করার অভ্যাস থাকে, তা হলে সেটা অর্থোরেক্সিয়ার লক্ষণ হতে পারে।
ওজন নিয়ে সামাজিক স্তরে ঠাট্টা-তামাশা করা, বা বংশানুক্রমিক কোনও মানসিক আঘাতের ইতিহাস থাকলে, তা-ও প্রভাব ফেলতে পারে খাদ্যাভ্যাসে।
অতিরিক্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকেও মানুষ ‘লুক্স’ নিয়ে বেশি সচেতন হয়ে পড়েন। তার ফলে শরীর ও খাদ্যাভ্যাসকে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতা জন্মায়। সেখান থেকেও এই সমস্যা হতে পারে।
নির্দিষ্ট তথ্য এখনও পর্যন্ত না মিললেও, সাধারণত কৈশোরে, বিশেষত কিশোরীদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়, জানাচ্ছেন ডা. রাম। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে যে তা চলে যাবে বা বেশি বয়সিদের মধ্যে যে এই সমস্যা দেখা দেবে না, এমনটাও নয়। ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট হিনা নাফিস বললেন, “আজকের দিনে সমাজমাধ্যম হোক বা টেলিভিশন, প্রায় সর্বত্র স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার উপরে জোর দেওয়া হয়। এটি প্রয়োজনীয়। কিন্তু তথ্যের সহজলভ্যতার কারণে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়াই অনেকে ঠিক করে ফেলেন, কোন খাবারটা কতটা পরিমাণে তাঁর জন্য উপযুক্ত।”
সঙ্গী হয়েছে নানা ধরনের অবৈজ্ঞানিক ‘ট্রেন্ড’ও। মাত্রাতিরিক্ত জল খাওয়া, লিকুইড ডায়েট, নো কার্ব ডায়েট, খাবারের বদলে শুধু সাপ্লিমেন্ট খাওয়া— এমন নানা কাণ্ডকারখানায় থাকে ‘ভাইরাল’ হওয়ার চেষ্টা। কিন্তু এই ট্রেন্ডগুলি মানুষকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়। এর ফলে নিজের ‘বডি ইমেজ’ কিংবা শুধুই নিজের ইচ্ছেমতো ‘স্বাস্থ্যকর খাওয়া’ নিয়ে এক প্রকার মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন অনেকে।
বোঝার উপায়
হিনা জানাচ্ছেন, স্বাস্থ্যকর খাওয়া আর অর্থোরেক্সিক হওয়ার মধ্যে পার্থক্যটা খুবই সূক্ষ। অ্যানোরেক্সিকরা যেমন সার্বিক ভাবে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেন, অর্থরেক্সিকেরা ঠিক সেটা করেন না। তবে দেখা যায়:
তাঁরা দিনের অধিকাংশ সময় শুধু নানা খাবারের পুষ্টিগুণ ও গুণগতমান নিয়ে পড়াশোনা করছেন।
নিজেই ঠিক করছেন কোন খাবার কতটা পরিমাণে তাঁর স্বাস্থ্যের জন্য ভাল, কোনটা খারাপ।
কোন খাবার কতটা পরিচ্ছন্ন ভাবে বানানো হচ্ছে, তার উপরে নির্ভর করে তাঁরা তা খাবেন কি না।
কোনও রেস্তরাঁ বা অনুষ্ঠান বাড়িতে গেলেও নিজের তৈরি খাবারেই ভরসা রাখেন অর্থোরেক্সিকরা। খেতে জোর করা হলে উদ্বিগ্ন, সন্ত্রস্ত হয়ে এমনকি দুর্ব্যবহার অবধি করেন।
যদি মনে হয়, খাওয়াদাওয়া সামান্য হলেও তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তবে নিজেকে গুরুতর শাস্তি দেওয়ার মতো পদক্ষেপ করতেও পিছপা হন না অনেকে।
অর্থোরেক্সিয়ার প্রভাবে
নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যক্তির জীবন। যেমন,
খাওয়া নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা করা বা প্রিয়জনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার ফলে পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তাঁরা।
সাধারণত শর্করা বা ফ্যাট জাতীয় খাবারের উপরে কোপ পড়লেও কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রোটিন বা ভিটামিন জাতীয় খাবার একেবারে বাদ দেওয়া হচ্ছে বা অতিরিক্ত ভাবে কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সময়ের সঙ্গে ওজন কমতে থাকে। কাজের প্রতি আগ্রহ, উৎসাহ কমে যায়।
অপুষ্টির লক্ষণও দেখা দিতে পারে। চুল ঝরে যাওয়া, ত্বকের ঔজ্জ্বল্য কমে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়।
এ ছাড়াও, মানসিক অবসাদ গ্রাস করতে পারে অর্থোরেক্সিকদের। প্রায় সব সময়, সব কিছু নিয়েই অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তাঁরা।
ভাবনাতেই সমাধান
ডা. রাম ও হিনা জানাচ্ছেন, বহু ক্ষেত্রে জরুরি অর্থোরেক্সিকদের মনোবল বাড়ানো। পরিবার ও পরিজনের বোঝানো জরুরি, ‘স্বাস্থ্যকর’ ভেবে যে খাদ্যাভ্যাস তাঁরা করছেন, তা আখেরে তাঁদের ক্ষতিই করছে।
পুষ্টিবিদ সুবর্ণা রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, এ ক্ষেত্রে এক দিনে সব কিছুর সমাধান হবে না। রোজকার খাদ্যতালিকায় এমন কিছু খাবার রাখতে হবে, প্রাথমিক ভাবে যেগুলির খাদ্যগুণ বোঝানো সম্ভব হবে। আবার একই সঙ্গে ওজন নিয়ন্ত্রণ ও স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও সাহায্য করবে।
তাঁর কথায়, “কলা, আখ, আপেলের মতো ফল রাখতে পারলে ভাল। ভাত, রুটি, পাউরুটি, মুড়ি, ডাল, মাছ, মাংস, ডিমের মতো খাবার যেন বাদ না যায়, সে দিকে নজর রাখা আবশ্যিক। বিশেষত শর্করা সমৃদ্ধ খাবার যাতে তাঁরা খান, তা খেয়াল রাখতে হবে। প্রাথমিক ভাবে এই ধরনের খাবার অর্থোরেক্সিকরা খেতে না চাইলেও, মনোবিদদের সাহায্যে তাঁকে বোঝাতে হবে ‘ব্যালান্সড ডায়েট’-এর প্রয়োজনীয়তা। সকালে চায়ের বদলে হেল্থ ড্রিঙ্ক আর বিকেলে চায়ের বদলে লস্যি বা স্মুদি খেলেও তা খাবারের পুষ্টিগুণ পেতে সাহায্য করে। সঙ্গে একটা কুকি বা অল্প চকলেটও খাওয়া যায়। তবে যে কোনও ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়ে তবেই এগোনো জরুরি।